বিআইডিএসের স্মরণসভা

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন দেশের আধুনিক অর্থনীতির আদিগুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে গতকাল বিআইডিএসের আলোচনা সভায় অতিথিরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, যাকে দেশের আধুনিক অর্থনীতির শিক্ষা ও গবেষণার আদিগুরু বলা হয়। ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি ও নীতি প্রণয়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। মধ্যপন্থী এ অর্থনীতিবিদ স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো কোনো জাতীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে গতকাল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক স্মরণসভায় তারা এ আক্ষেপ প্রকাশ করেন। 

‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম: নানা প্রজন্মের দৃষ্টিতে দেখা’ শিরোনামের এ স্মরণসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সহকর্মী, ছাত্র, অর্থনীতিবিদ, বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালকসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা। আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, রাশেদ খান মেনন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান প্রমুখ। সভাপতিত্বের পাশাপাশি অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধু তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পর্যন্ত জানানো হয়নি। 

স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের বড় পদে যোগ না দিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। তার সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান। স্মরণসভায় বক্তারা উল্লেখ করেন, পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার সময় তারা আমলাতন্ত্রের বাধার মুখে পড়েন। তিন বছরের মাথায় পদত্যাগ করার জন্য এক দফা তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তাদের থেকে যেতে হয়। তবে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কিছুটা অভিমান নিয়ে ১৯৭৫ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে ছুটি নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে যান। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের হৃদয়বিদারক ঘটনা। সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। নুরুল ইসলাম মাঝেমধ্যে দেশে এসেছেন। কিন্তু সরকার কখনো তাকে কোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্য ডাকেনি। এর মধ্যে ৯৪ বছর বয়সে গত ৮ মে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘৬০-৭০-এর দশকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাদের নাম খুব উচ্চারিত হতো তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। পরিকল্পনা কমিশন উঁচু পতাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা নেমে আসে। এটা হয়তো ওনাকে ব্যথিত করেছিল। পরিকল্পনা কমিশনে যেসব বাধা নুরুল ইসলামকে ব্যথিত করেছিল, তা এখনো আছে। স্বীকার করতেই হবে পরিকল্পনা কমিশন সেই মর্যাদায় নেই।’ 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্ত করার দারুণ ভূমিকা ছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলামের। তবে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ায় হয়তো তিনি জাতীয় স্বীকৃতি পাননি। শুরুতে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মপরিধি অনেক ব্যাপক ছিল। বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থ বিভাগের সঙ্গে তাদের বিতর্ক হতো। ব্যয় বাড়াতে মন্ত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদও হতো। তখন বঙ্গবন্ধু এসব ঝামেলা 

মেটাতে গিয়ে ব্যয় বাড়িয়ে দিতে বলতেন। প্রশাসনের সঙ্গেও ঝামেলা হয়েছিল কমিশনের। তাৎক্ষণিক অ্যাডহক ভিত্তিতে কমিশনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বেশ প্রফেশনাল লোকজনকে নিয়োগ করেছিলেন। তবে প্রশাসনিক বিভাগ থেকে আমলাতন্ত্রের নিয়োগের ভিত্তিতে লোকবল নেয়ার কথা হয়। কিন্তু অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে বিশেষভাবে সেটাও অনুমোদন নিয়ে নিলেন। ইআরডিতেও ঝামেলা হচ্ছিল। পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান।’

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সরাসরি ছাত্র ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম ছিলেন কল্যাণ অর্থনীতিবিদ। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল ছিল। এজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আপনি করে বলতেন। অনেক খাতির করতেন। ছয় দফা প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—কী মনে হয়, এগুলো খাবে তো? বাম বা ডান নয়, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কল্যাণ অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু উনাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক এবং কৃষি অর্থনীতিতে উনার মতো আর কেউ আসবেন কিনা জানি না।’ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নুরুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকের মতো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। দিলে ভালো হতো। তবে আমরা সবসময়ই তাকে সম্মানের বেদিতে বসাই। এটাই তার বড় পুরস্কার।’

অর্থনীতির সব বিষয়ে কাজ করা দেশের খ্যাতনামা এ অর্থনীতিবিদকে পূর্ণাঙ্গ এবং সর্বাঙ্গিন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আখ্যা দেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক শিক্ষা ও গবেষণার আদিগুরু ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। উন্নয়ন অর্থনীতিকে বার্ডস আই ভিউতে দেখায় ওনার মতো কেউ ছিল না। আন্তর্জাতিক সেমিনারে অনেক নোবেল লরিয়েটকেও তিনি ছাড়িয়ে যেতেন। তার সঙ্গে দ্বিমত করে পার পাওয়া যেত না। তবে একুশে পদক না পাওয়ায় তার কোনো আক্ষেপ ছিল না।’ 

বাংলাদেশের সংবিধানপ্রণেতাদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন। তিনি নুরুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নুরুল ইসলামের পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং পরবর্তী সময়ে তাকে বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা করার ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা ছিল। ছয় দফা অনুসারে আওয়ামী লীগের ইশতেহার (১৯৭০) তৈরি, স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নীতি প্রণয়নে নুরুল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।’

রাশেদ খান মেননের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ বিষয়ে মেনন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম ছাত্রদের প্রতি অপত্যস্নেহ পোষণ করতেন। রাজনীতি করার কারণে প্রায়ই আমাকে জেলে যেতে হতো। একবার জেল থেকে বের হওয়ার পর অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমাকে বলেন—তুমি পরীক্ষা দেবে। যা পারো লিখবে। খাতা আমরা দেখব।’ তিনি আরো বলেন, ‘খুবই ভালো হতো যদি আমরা তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিতে পারতাম।’ 

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ৯০ বছর বয়সেই চারটি বই লিখেছেন। ২০১৪ সালে দেশে এসে তরুণ গবেষকদের সেমিনারে বলেছিলেন—জ্ঞান অর্জনের জন্য ঘাম ফেলার মাধ্যমে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী দরকার। বঙ্গবন্ধুর বিশেষজ্ঞ দলে তিনি কাজ করেছেন। যদিও বিশ্বব্যাংকের গবেষণা পরিচালক পদে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও দেশ গঠনে তিনি এসেছিলেন। সঠিক সংখ্যা, গবেষণা এবং পরিকল্পনায় জোর দিতেন তিনি। যদিও এখনো আমরা বিবিএসের তথ্য সংখ্যা নিয়ে সংকটে পড়ি। শেষ দিকে দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অনুদার গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতেন। এখন একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। লিখতে-বলতে আমাদের তিন-চারবার ভাবতে হয়।’ 

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেয়ে রুমিন রহমান বলেন, ‘আমার বাবা নুরুল ইসলাম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দিকে বেশি জোর দিতেন। কারণ, তিনি মনে করেন, সঠিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়া নীতিনির্ধারণ করা যায় না। তিনি ইতিহাস পাঠের ওপরও জোর দিতেন। কারণ, একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানা খুব জরুরি।’ 

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। রাজনৈতিক আগ্রহ থেকে তিনি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলতেন। স্বাধীনতার জন্যও কাজ করেছেন কিন্তু কেন তিনি জাতীয় পদক পাননি তা আমার বুঝে আসে না। বাংলাদেশে অনেককে মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়া হলেও মন্দ হয় না।’  

বিআইডিএসের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত স্মরণসভায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দিন, অর্থনীতিবিদ সাজ্জাদ জহির, আহমাদ আহসান প্রমুখ সরাসরি উপস্থিত এবং অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন