বিশ্লেষণ

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও আগামীর বাংলাদেশ

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

জনসংখ্যা জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ হলো সম্প্রতি। প্রাথমিক জরিপ-পরবর্তী যাচাইয়ের কাজ শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার। তার পরও জনসংখ্যার মোট সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে এবারের নিবন্ধে আমি যেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই সেটি হলো যুব বা তরুণ জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ৪২ দশমিক ৮৪ শতাংশ ১৫-৩৯ বছর বয়সী। এছাড়া শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী ২৮ দশমিক ৮১ এবং চল্লিশোর্ধ্ব মানুষের হার ২৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। তরুণ শ্রেণীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ। জনসংখ্যা জরিপের এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ হবে কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের ওপর নির্ভর করতে হবে সবচেয়ে বেশি।

আমাদের তরুণদের নানামুখী আকাঙ্ক্ষা আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবায়নে সমাজ কীভাবে সাজানো হচ্ছে সেটি দেখা প্রয়োজন। একটা বিষয় হচ্ছে, তরুণরা সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে। আরেকটা বিষয় হলো, তরুণ জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। সন্দেহ নেই, তরুণ-তরুণীদের ভূমিকাই আগামীতে আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে আসবে। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের অর্থনৈতিক শক্তির দিকটি বোঝাতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটা বৃহৎ ধারণা। ডিভিডেন্ড বিষয়টি অটোমেটিক নয়। ডিভিডেন্ড পেতে হলে শ্রম দিতে হয়, বুদ্ধি দিতে হয়, কৌশল অবলম্বন করতে হয়। ডিভিডেন্ড আপনা-আপনি হাসিল হয় না। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়টা বোঝা খুব জরুরি। বাংলাদেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর এ তরুণ আধিক্য সবসময় থাকবে না। পরবর্তী পর্যায়ে তরুণদের চেয়ে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। অনেক দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়কাল বড় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের হাতে আছে মাত্র একটি দশক। আগামী এক দশকে অনেক কাজ করতে হবে। আগামী এক দশক হবে রূপান্তরের দশক। 

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে তৈরি করতে হবে, তাদের সুযোগ করে দিতে হবে। চালকের আসনে তাদের বসাতে হবে। এটা একটা চেইন। এখানে মূলত তিনটি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, তরুণদের মানবসম্পদে রূপান্তর ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের জন্য সমাজ-অর্থনীতির পরিবর্তনের সুযোগগুলো তৈরি করতে হবে, তৃতীয়ত, তাদের চালকের আসনে বসাতে হবে। আর এগুলো হতে হবে সমান্তরালভাবে। বাংলাদেশ আগামী দশক নিয়ে চিন্তা করছে বটে। কিন্তু সেটি গতানুগতিক নাকি বাংলাদেশের আরো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা বলবে তা দেখার বিষয়। 

প্রতি বছর ১৫-১৮ লাখের মতো মানুষ নতুন করে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে। তাদের মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী দশককে যদি রূপান্তরের দশকে পরিবর্তন করতে চাই তাহলে পরিসংখ্যান নিয়ে আত্মতৃপ্তি থেকে আমাদের বের হতে হবে। বাংলাদেশের সর্বশেষ শ্রম জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার খুবই কম। এর পেছনে রয়েছে সংজ্ঞাগত জটিলতা। আইএলও বেকারের সংজ্ঞায়ন করেছে—সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলে তাকে বেকার বলা যাবে না। এর মাধ্যমে দেশে বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণে থাকার দাবি করা হচ্ছে। আমাদের মতো সমাজে যেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার সবচেয়ে বড় সেখানে আইএলওর সংজ্ঞার প্রয়োগ কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। আইএলও বেকারত্বের আরো অনেক সংজ্ঞা দিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের শ্রম জরিপে তা আমলে নেয়া হয়নি। যে সংজ্ঞাটি সুবিধাজনক মনে হয়েছে সেটিকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আমাদের প্রেক্ষাপটে এ সংজ্ঞার মূল্য কতটা তা যাচাই করে দেখা দরকার ছিল। আইএলওর প্রতিবেদনের জন্য এ সংজ্ঞা প্রয়োজন হতে পারে; তবে আমাদের বোঝা প্রয়োজন পরিসংখ্যান দিকনির্দেশনা প্রদানে সহায়তা করছে কিনা। বেকারত্ব কম দেখানোর মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই; বরং এতে নীতিনির্ধারণে সমস্যা তৈরি হয়, ঠিক যেমন চালের উৎপাদন, জোগান ও চাহিদার তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় প্রতি বছর। এতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। 

অকার্যকর পরিসংখ্যানের আত্মতৃপ্তির মোহের মধ্যে আটকে থাকা নীতিনির্ধারকদের প্রথম সমস্যা। এ মোহ থেকে বের হওয়া জরুরি। কারণ আগামী দশক বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দশক। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা আমরা কাজে লাগাতে পারব কিনা, তরুণদের মানবসম্পদে তৈরি করতে পারব কিনা, সুযোগ তৈরি এবং চালকের আসনে বসা এ তিন কাজ সম্পন্ন হবে কিনা—ইত্যাদি প্রশ্ন রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তার জায়গার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ ধরনের জাতীয় আলোচনা খুব জোরালোভাবে হওয়া উচিত। 

আমি আজকাল জাতীয় আলোচনার মতো শব্দ ব্যবহারে সংকোচ বোধ করি। কারণ আলোচনাটা আজ শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এখন আর সুফল পাওয়া যায় না। শুধু আলোচনার জন্য যখন আলোচনা হয় তখন আলোচনা কোনো সত্যিকার পরিবর্তন নিয়ে আসে না। আগামী দশককে যদি সত্যিকারের রূপান্তরের দশকে পরিণত করতে হয়, তাহলে আলোচনাকে কার্যকর এবং কৌশলী করতে হবে। এখনকার আলোচনার অন্যতম দুর্বলতা হলো বৃহত্তর মনোযোগকে আকৃষ্ট করতে না পারা। কিছু আলোচনা বৃহত্তর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে কিন্তু কোনো কাজের নয়। সেগুলোর ভিন্ন একটা প্রেক্ষিত আছে। বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর মনোযোগ আকর্ষণ এবং তাদের সম্পৃক্ত করার মতো আলোচনা সমাজে জারি করা খুবই জরুরি। প্রশ্ন হলো, কোথায় হবে আলোচনা? যারা পরিসংখ্যানের আত্মতৃপ্তির মোহে আটকা পড়ে আছে তাদের উদ্যোগে এসব আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। কারণ তাদের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য চিন্তার উন্মেষ ঘটানো নয়, বরং গতানুগতিক ধারাকে বজায় রাখা। আলোচনায় একটা কথা বারবার আসে, তা হলো দিকনির্দেশনাটা আসবে কীভাবে? এক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কার্যকর আলোচনা এবং আলোচনা থেকে কৌশলগত যেসব চিন্তা উঠে আসবে সেগুলোকে সাজানো। দ্বিতীয়ত, আলোচনার কৌশলগত বিষয়গুলো চিন্তায় রূপান্তর ঘটানো। 

তরুণদের ভাবনা অর্থাৎ তারা কী ভাবছে, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী, তাদের আশা কী ইত্যাদি বিষয় জানা খুবই জরুরি। তরুণদের শক্তি ও সাহস রয়েছে। প্রয়োজন তাদের শক্তি ও সাহসকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা। তারা কীভাবে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে চিন্তা করছে সেগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এতে বৃহৎ জনসম্পৃক্ততার জোয়ার তোলা প্রয়োজন। 

কিছু কিছু বিষয় এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কোথায় আমাদের হাত দেয়া দরকার। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড যদি অর্জন করতে হয় সেখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার। অনেকে বলতে পারেন, একটা শিক্ষা কমিশন করা হোক। শিক্ষা কমিশনের পথ হচ্ছে গতানুগতিক, সেটি কোনো নতুন চিন্তার পথ নয়। এটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরো বাড়াবে। কমিশন হবে কিন্তু কোনো কাজ হবে না, যেমনটি অতীতে ঘটেছে। শিক্ষা কমিশন গঠনের মতো চিন্তা হচ্ছে অনেকটা আয়েসি আমলাতান্ত্রিক ও এলিটিস্ট চিন্তা। একটি সময়ের জন্য চিন্তাটা ঠিক ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আয়েসি আমলাতান্ত্রিক এলিটিস্ট চিন্তার মধ্যে বিষয়টি আবদ্ধ থেকে যায়। কৌশলগত চিন্তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ কাজ কেতাবি ধরনের হয়ে যায়, যা ব্যয় বাড়ালেও কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন হয় না। 

শিক্ষার মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষার বিষয়টা মৌলিকভাবে পুনর্বিবেচনা করতে হবে, ভিন্ন আঙ্গিকে পুরনো নিয়মে শিক্ষা কমিশনের ফর্মুলায় নয়। আমাদের শিক্ষা কমিশন গঠনের বদলে অ্যাকশন প্ল্যান এক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা হতে পারে। এসবও যেন কেতাবি বিষয়ে পরিণত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অ্যাকশন প্ল্যানের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাকে ভিন্ন ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো জরুরি। আমরা যখন মানবসম্পদ তৈরির কথা বলি তখন শিক্ষার বিস্তার ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সমার্থক নয়—এটা বাংলাদেশে খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে এখনো বহু বিদেশী কাজ করছে। তরুণদের মেধা নেই, ব্যাপারটা তা নয়। আমাদের দেশের তরুণরা যখন বাইরে যায় তখন তারা খুব ভালো করে। বিষয়টি মেধার অনুপস্থিতি নয়, এটা গড়ে তোলার অস্ত্রের ঘাটতি। শিক্ষাকে আমরা কেতাবি বিষয় বানিয়ে ফেলেছি, সার্টিফিকেটের বিষয় বানিয়ে ফেলেছি। এভাবে চলছে অকার্যকর শিক্ষা দান। এতকিছুর মধ্যে স্বদক্ষ হওয়ার অর্থাৎ নিজে নিজে শেখার প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। শিক্ষার মানের উন্নয়ন বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এখান থেকে শ্রমবাজারে যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ আমরা এখনো সেই সস্তা শ্রমের প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এগুলোয় আমরা কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই শিক্ষা বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহসী সংস্কারের চিন্তা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিক ধারণা কারাবন্দি করে ফেলেছে। এর জন্য আমলারা দায়ী, বিষয়টি তা নয়। সমস্যা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা। 

বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্তি বলে একটি ব্যবস্থা আছে। সরকার বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিয়ে থাকে। এটি প্রথম শুরু হয়েছিল আশির দশকে। স্বল্পকালীন একটি উদ্যোগ ছিল। এখন এটাই মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, তবে মানের অবনমন হয়েছে। বাংলাদেশে উচ্চ বেতন দিয়ে ভালো শিক্ষা দেয়া ও পাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। ইংরেজি মাধ্যম ও বাংলা মিডিয়ামের মধ্যেও এমন ধরনের ভাগ রয়েছে। একসময় সরকারি জিলা স্কুলগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষার মানের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এমপিওভুক্তি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষায় এক ধরনের রাজনীতিকরণ ঘটেছে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে রাজনীতিকীকরণের প্রতিযোগিতা প্রবেশ করেছে। ফলে শিক্ষার মান উন্নয়নের চেয়ে সরকারকে খুশি রাখতে শিক্ষক ও স্কুল কমিটি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে এমপিওভুক্ত হওয়া যায় না। ফলে তারা কোনো ধরনের জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছে না। তাই এমপিও সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো গেলেও মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে এর সূত্র ধরে স্কুল পরিচালনায় আমলাতান্ত্রীকরণ ঘটেছে। এখানে শিক্ষকরা চালকের আসনে নেই, বরং শিক্ষা প্রশাসক চালকের আসনে বসেছেন। 

এমপিও সিস্টেমে রাষ্ট্রের বিপুল খরচ হচ্ছে কিন্তু সেটি কার্যকরভাবে ব্যবহার হচ্ছে না অর্থাৎ অর্থের অপচয় ঘটছে। এসব স্কুলকে কি সরকারি স্কুলে বদলানো সম্ভব নাকি আমরা সরকারি বাজেটের মাধ্যমে আরো ৫০০টি স্কুল তৈরি করব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের আরো ভাবতে হবে। হঠাৎ করতে মন চাইল, দেখে করে ফেলা যাবে না। জাতীয়ভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার যে চ্যালেঞ্জ আছে তাকে নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা করা না হলে তরুণ সমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে পারব না। এছাড়া আমাদের ভয়াবহ আরেকটি সমস্যা আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় অনার্স ও মাস্টার্সধারীরা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলোর অধিকাংশে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। পরিচালনার দুর্বলতা আছে, যার ফলে একটা ভয়াবহ অবস্থার তৈরি হয়েছে। সার্টিফিকেটসর্বস্ব ডিগ্রিধারী বেড়েছে। কিন্তু মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজের বিষয়টিও আবারো পুনঃচিন্তার দরকার রয়েছে। আরো গভীর বিষয় হচ্ছে, আমাদের পাঠদানের ধরনে পরিবর্তন প্রয়োজন। এখানে শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা চলছে। এ পরীক্ষামূলক কাজ সবসময় আমলাতান্ত্রিক। নতুন শিক্ষা কার্যক্রমকে কার্যকর করার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ। এখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে নামকাওয়াস্তে। শিক্ষকদের দোষ দেয়া যাবে না। প্রশিক্ষণ প্রদানে ত্রুটি রয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন নতুন যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ঘাটতির জন্য সেটিও শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। আগামীতে পর্যাপ্ত ও কার্যকর শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়টিকে মহাপ্রকল্প হিসেবে নেয়া জরুরি। সেটি বাস্তবায়নে সার্বিক শক্তি নিয়ে নামা দরকার। সমাজের যেখানে যেখানে সক্ষমতা আছে—সেটা যদি বেসরকারি খাতেরও থাকে তাদের কাজে লাগানো উচিত। 

আমাদের তরুণ প্রজন্মকে শারীরিকভাবে ফিট হতে হবে। তরুণদের দৌড়, সাঁতার কাটা, পর্বত আরোহণসহ কঠোর পরিশ্রমের সক্ষমতা থাকতে হবে। বাংলাদেশের তরুণরা ক্লাসরুমে অনেকটা কারাবন্দি হয়ে আছে। এখানে ক্লাসরুমের বাইরে ব্যক্তিত্বের বিকাশ, মনের বিকাশের সুযোগও যেন কারাবন্দি হয়ে আছে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে কয়েকটি সার্টিফিকেট প্রদানের মধ্যে বিষয়টি সীমাবদ্ধ নয়। তাই ক্লাসরুমের ভেতরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসরুমের বাইরের জগৎকেও আমাদের নতুনভাবে চিন্তার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে স্পোর্টস ও সংস্কৃতি এবং উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দিতে পারি। তাদের জাতির উন্নতি ও পুনর্গঠনে সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনী চিন্তাকে অন্যতম বিষয় হিসেবে নিয়ে কাজ করেছেন। তার ফলাফল কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীব্যাপী কোরিয়ান মিউজিক, মুভির মাধ্যমে কোরিয়ান সংস্কৃতি বাজিমাৎ করেছে। কিন্তু সে তুলনায় আমরা কী করেছি। সংকীর্ণতম রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমাদের অনুদানের সংস্কৃতি গেড়ে বসেছে। মুভি বা সিনেমা তৈরি হচ্ছে যেটা সত্যিকার অর্থে কেউ দেখতে যায় না। আমাদের সংস্কৃতিও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ধারায় আটকে যাচ্ছে।

আগামী এক দশক বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন ধরনের দশক হতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের কয়েকটি জায়গায় জোর দিতে হবে। প্রথমটা হচ্ছে, তরুণদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং তাদের সম্পৃক্ততার নতুন জোয়ার তৈরি করতে হবে। এ জোয়ার শুধু ঢাকার মধ্যে হলে হবে না সারা দেশে করতে হবে। দ্বিতীয়টা, তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা, তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করা এবং তাদের চালকের আসনে বসার পথগুলো খুলে দেয়া। আর এগুলোকে নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষাকে একটা নতুন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করাতে হবে। সেটার জন্য দুটি বড় ধরনের ক্ষেত্রের একটা হচ্ছে স্পোর্টস এবং অন্যটি হচ্ছে সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনী সৃজনশীলতামূলক চিন্তার জগৎ তৈরি। এগুলো করতে গেলে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। আজকের নিবন্ধটি শেষ করব একটি বিষয় বলে। বাংলাদেশের অনেক ধরনের সমস্যা আছে। অনেক সমাধান চিন্তাও আছে। কিন্তু মূল সংকট হলো পরিবর্তন আনার জিদের অনুপস্থিতি। এখন মূল সংকট হচ্ছে জিদের ঘাটতি অর্থাৎ করেই ছাড়ব এমন তাগাদা নেই আমাদের মধ্যে। জিদের উপলব্ধি যদি আমাদের মধ্যে আসে তাহলে পরিবর্তন আসবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন