অভিমত

এসএমই উদ্যোগের প্রতি ন্যায়সংগত আচরণ

ফেরদাউস আরা বেগম

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় সম্মেলনে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বিশেষ করে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে অন্যতম বাধা হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ডাক বা কল টু অ্যাকশন শীর্ষক একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করে একযোগে কাজের অনুরোধ জানানো হয়। এখানে বলা হয়, এসএমইদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের প্রতি ন্যায় আচরণ হলে তারা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে। 

এ কথা অবশ্য সত্য যে ২০১৩ সালের তথ্য দিয়ে এসএমই খাতের অবদান পর্যালোচনা সম্ভব নয়, কারণ বিগত ১০ বছরে এ খাতে নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২০২৩ সালের সমীক্ষায় আমরা সেসব পরিবর্তন দেখতে পাব। এদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। অনেক নতুন এবং স্মার্ট শিল্প উদ্যোগ তৈরি হয়েছে, যার রয়েছে প্রচুর বহুমুখিতা। নন-ট্র্যাডিশনাল অনেক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়েছে, যা মোট শিল্পে ব্যাপক অবদান রাখছে। তবে গভর্ন্যান্স ব্যবস্থার আরো উন্নয়ন হলে এসএমই খাত দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারত বলে মনে করা যেতে পারে। পৃথিবীতে খুব দ্রুত পরিবর্তন আসছে। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব থেকে ক্রমাগত পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের দিকে যাচ্ছি। কাজেই আমাদের দ্রুত টেকনোলজি গ্রহণ ও উন্নয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে এসএমই খাতের জন্য ন্যায় আচরণ বিশেষভাবে জরুরি।

কল টু অ্যাকশন শীর্ষক এ যৌথ প্রস্তাব পেশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইউএস অ্যাম্বাসেডর বলেন, ‘‌করাপশন পাথহোলস এবং করাপশনের উপস্থিতি সব জায়গাতেই রয়েছে; এমনকি তাদের দেশেও, যার জন্য টাকা খরচ, ঘুস এগুলোর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।’ তিনি এগুলোকে একটি পারাসাইট হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এগুলো গভর্ন্যান্সের প্রতিটি স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিষয়টি পৃথিবীর সব দেশকে পেনালাইজ করছে। তিনি করাপশনকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সমস্যাটি আগে বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের জন্য দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কতিপয় বিষয়ের ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন, যেমন আরজেএসসি থেকে বিজনেস রেজিস্ট্রেশন; এনবিআর কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের বিষয়টির অটোমেশন, পিপিপি অথরিটি পূর্ণ বাস্তবায়ন, মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি। বাংলাদেশে অনেক আইন রয়েছে তবে বাস্তবায়ন দুর্বলতা আছে, অন্যান্য দেশে বিশেষ করে ইউএসে আইন না মানার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রয়েছে।

এর আগে যে নতুন ধারার শিল্প বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে তার আরেকটি নিয়ামক হলো দ্রুত অটোমেশন। এক্ষেত্রে সরকার অনেক ধরনের ব্যবস্থা নিলেও তার সুফল প্রাপ্তি নানান কারণে সম্ভব হয়নি। অনেকেই মনে করেন এর থেকে অ্যানালগ ব্যবস্থাই ভালো। এদিকে অবশ্য সাপ্লাই ও ডিমান্ড উভয় ক্ষেত্রেই দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে এসএমই এবং এর মধ্যে অতিক্ষুদ্র এবং মাইক্রো, যাদের সংখাই বেশি তাদের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার, যাতে তারা নিজে থেকে অটোমেশন থেকে সুফল লাভে তৎপর হতে পারে এবং এক্ষেত্রে চাহিদার সৃষ্টি করে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তা নিজে নিজে অটোমেশনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেসন, কর প্রদান, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন না। কোনো না কোনোভাবে তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপরই নির্ভরশীল হতে হয়, এর কারণ কী তা খতিয়ে দেখা দরকার। সফটওয়্যারের ফিল্ডগুলো সঠিকভাবে না থাকা, একটি পর্যায় শেষ করে পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, সার্ভারের দুর্বলতা, কোনো কারণে এমেন্ডমেন্টের দরকার হলে সেক্ষেত্রে বেশ বড় রকমের সমস্যার কথা উদ্যোক্তারা বলে থাকেন। এছাড়া যিনি এ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে থাকেন তার সহযোগিতা ইত্যাদি নানান ধরনের কারণে এর সুফল এখনো সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। এছাড়া এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর এমপাওয়ারমেন্ট দরকার রয়েছে, যাতে অনলাইন ও ক্যাশলেস ট্রানজেকশন বাড়ানো যায়। এ লক্ষ্যে সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার রোল গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে অনেকদূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব। রুল অব ল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ আরো অধিক হারে বাড়ানো সম্ভব হবে। বিষয়টির ওপর জোর দেয়া দরকার।

উল্লেখিত এ প্রস্তাবে বলা হয় যে এসএমই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের যোগাযোগের ঘাটতি থাকে। ফলে যে নীতিমালা প্রণীত হয় তার সঙ্গে তাদের চাহিদার সামঞ্জস্য অনেকটাই থাকে না। এক্ষেত্রে যেসব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে তারাও সঠিকভাবে সবসময় তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। দুই বছর ধরে গবেষণায় সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ বা সিজিএস দেশের দশটি ট্রেড বডির ১৫২টি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছে, যা মূলত এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি। তারা দেখার চেষ্টা করেছেন যে এসব ডকুমেন্টের মধ্য দুর্নীতি দমনের জন্য কোনো বিশেষ কার্যক্রম আছে কিনা। এ দলিলাদি ও নথিসমূহে পাঁচটি মূল বিষয় যেমন গণতন্ত্র, শাসন ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতি অনেকটাই অনুপস্থিত। তবে এটি অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে নীতিমালা সংস্কার সুপারিশগুলো মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য করা হয়, যাতে এসএমই এবং অন্য ব্যবসায়ীরা সঠিকভাবে ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। তারা চেষ্টা করেছেন এসএমইগুলো কীভাবে ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিগুলো দমনের ক্ষেত্রে পরিত্রাণ পেতে পারে, কিন্তু সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু জানা যায়নি। এতে মনে হয় এরা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ তারা আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা থেকে বরং আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে ব্যবসা পরিচালনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দিনে দিনে ইনফরমাল ব্যবসার সংখ্যা বাড়ছে, এতে তারা সরকার ঘোষিত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা, দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া, অস্পষ্টতা, ডকুমেন্টেড কাগজপত্রের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে আন-ডকুমেন্টেড কাগজপত্রের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি অন্যতম কারণ। 

সিজিএস ও সাইপের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত শীর্ষক একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (জুলাই ২০২২) বলা হয়, এসএমই ও অন্য ক্রীড়নকদের মধ্যকার সম্পর্ক বিদ্যমান দুর্নীতি চর্চার আরেকটি গুরুতর উপাদান। একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সূত্রে জানা যায়, ব্যবসায়ের কমপ্লায়েন্সের শর্তাবলি পরিবর্তন করার জন্য ব্যাংকগুলো ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোপন যোগাযোগ থাকতে পারে। সিজিএসের দুটো সার্ভে, যেমন এসএমই খাতের মূল্যায়ন যেখানে তারা ৮০০ প্রতিষ্ঠানের (সেপ্টেম্বর ২০২২) ওপর জরিপ করে, যার মধ্যে ৪০০টি উৎপাদন ও ৪০০টি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিবিএসের তথ্য মোতাবেক এ খাতে তিনটি উপখাত বেছে নেয়া হয়। উৎপাদন খাত যেমন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল, তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস, কাগজ, প্যাকেজিং ও মুদ্রণ, প্লাস্টিক, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক শিল্প। কৃষি খাতের মধ্যে হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ খামার, মাছ ধরা এবং মাছ প্রক্রিয়াকরণ। অন্যদিকে পরিষেবা খাতের মধ্যে নির্মাণ এবং রিয়েল এস্টেট, হাসপাতাল এবং ক্লিনিক, শিক্ষা, পরিবহন, গুদাম এবং যোগাযোগ, হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট, কম্পিউটার, হার্ডওয়্যার এবং আইসিটি সরঞ্জাম, পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য। আরেকটি হয়েছিল হাউজহোল্ড সার্ভে, যেখানে প্রায় এক হাজার হাউজহোল্ড সার্ভে করা হয়েছে (২০২১-এর আগস্ট পর্যন্ত)। এ সার্ভেতে স্বাস্থ্য খাত সামনে চলে এসেছিল। এ সার্ভেতে তারা দেখাচ্ছিল যে প্রায় ৭৩ দশমিক ৬০ ভাগ পরিবারের ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছিল। কভিডের সময় সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তবে এর মধ্যে প্রায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার ন্যায় আচরণ পায়নি। প্রণোদনা পেয়েছে এমন সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। প্রতিষ্ঠানটি আট ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কনসালটেটিভ মিটিং করেছে। প্রায় ১৯৪ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে সভা করেছে। দেখা যায় এসএমই উদ্যোক্তারা আইন মেনে চলতে চান কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে তারা বাধ্য হন অন্য ব্যবস্থা নিতে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় কর প্রদানে। 

সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন অ্যান্টিকরাপশন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে কিন্তু তার পরও তারা লক্ষ করেছেন যে উৎপাদন ও সেবা খাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বিরাজমান। তিনটি বিষয় অর্জন তাদের মূল লক্ষ্য ছিল। প্রথমত, এসএমই খাতের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা ব্যবহার করা যাতে বাংলাদেশ সামনের দিকে আরো এগিয়ে যেতে পারে; দ্বিতীয়ত কর্মসংস্থান বাড়ানো, তৃতীয়ত, বেসরকারি খাতের মাধ্যমে যে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তার সম্ভাবনাকে ধরে রাখা যাতে তা আরো সামনের দিকে বাড়তে দেয়া যায়। এটি অবশ্যই আশা করা যেতে পারে যে সঠিক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সরকার, বেসরকারি খাত, উদ্যোক্তা, এসএমই সবাই যদি এক সঙ্গে কাজ করে তাহলে দুর্নীতির প্রকোপ কমিয়ে আনা যাবে। যথাযথ ডকুমেন্টেশন এবং পরিচালন ব্যবস্থার কারণে অনেক এসএমই সরকারি প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না। যার ফলে এরা তেমনভাবে প্রতিযোগী হতে পারছে না। এসএমইগুলো বিশেষ করে কুটির এবং মাইক্রো যাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি তারা আনুষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হয়। বরং অনানুষ্ঠানিক খাতে কম খরচে আরো স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা করার সুযোগ গ্রহণ করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক খাতের দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করে। এ ধরনের মনোভাব একটি প্রকৃত বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাস্তবিকই চিন্তার বিষয়। 

এ গবেষণার মূল পর্যবেক্ষণে বলা হয় যে দুর্নীতির একটি চাহিদা সরবরাহের দিক আছে, বিধিবিধান অত্যধিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ, যা দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করছে, দুর্নীতিবিরোধী আইন দুর্বল এবং শিথিল প্রয়োগ দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা আমাদের সাহসী করেছে, আমরা স্বপ্ন দেখছি একটি উন্নত দেশের আত্মবিশ্বাসী মানুষ হতে, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাই একযোগে কাজ করার উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। আমরা সবাই সচেষ্ট হলে দুর্নীতি দমনে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।

ফেরদাউস আরা বেগম: সিইও, বিল্ড—একটি পাবলিক প্রাইভেট ডায়ালগ প্লাটফর্ম 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন