উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্য অর্থনীতিকে চাপে ফেলবে

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হোক

কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য কমার কোনো সুফলই মিলছে না। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য অর্থনীতিতে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক মানুষ কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। তাই সামগ্রিক অর্থনীতিতেই এর প্রভাব পড়তে পারে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের বাজারে সার এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে বাজারসংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বিশেষ করে রাসায়নিক সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে তা খাদ্যের উৎপাদন এবং বাজার পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। ব্যাহত হবে খাদ্যনিরাপত্তা। একই সঙ্গে খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে।

যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে রাসায়নিক সারের দাম চলতি বছরের শুরু থেকেই টানা কমতির দিকে। বিশ্বব্যাংকের পিংক শিটের তথ্য অনুযায়ী, সারের দাম গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কিছুটা অস্থিতিশীল সময় পার করলেও এখন তা কমছে। বর্তমান বাজারে সারের দাম কভিড-১৯-এর পূর্ববর্তী সময়ের কাছাকাছি রয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এমনকি দুর্গম অঞ্চলে বাড়তি দামের চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে সার কিনতে হচ্ছে। সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডিলার ও কৃষক পর্যায়ে সম্প্রতি সারের দাম বাড়িয়েছে সরকার। গত ১১ এপ্রিল প্রতি কেজি ইউরিয়া, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) সারের দাম ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরা বর্ধিত দামেও সার পাচ্ছেন না। পরিবহন খরচের কথা বলে ডিলাররা বাড়তি দামে সার বিক্রি করছেন। আর বেশি দামে সার কেনায় প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদন খরচও বাড়ছে।

এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে কমানো হচ্ছে না। বরং এ খাত থেকে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নিয়ে সরকার মুনাফা করছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতির জন্য বিশ্ববাজারকে দায়ী করার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটি এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়; বরং দেশীয় কারণেই এখন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার একদিকে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, তেমনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এখন মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে বিদেশ থেকে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

এদিকে আগামী দিনগুলোতেও সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনসহ সার্বিক সরবরাহ চেইন আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন খাতে সেচ এবং বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যয়কে আরো বাড়িয়ে তুলবে। একই সঙ্গে খাদ্য শিল্পের কারখানাগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী সার, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। সামনে আরো বাড়ানো হবে। এর স্বল্পমেয়াদি প্রভাবে কৃষি খাতে উৎপাদন ব্যাহত ও বাজার অস্থিতিশীলতা বাড়তে পারে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির বেশকিছু সূচকের ব্যাপক অবনমনের আশঙ্কা রয়েছে। এতে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চলমান এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে শক্ত হাতে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা প্রয়োজন। উৎপাদন খাতে ভর্তুকি প্রদান করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকারকে মনোযোগী হতে হবে। এমনিতেই বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মাঠপর্যায়ে কৃষক সরকার নির্ধারিত মূল্যেও সার পাচ্ছে না। এজন্য দুর্গম অঞ্চল চিহ্নিত করে প্রয়োজনে বাড়তি পরিবহন খরচ দেয়ার বিষয়টি কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিবেচনা করা উচিত। মোট কথা, কৃষক যেন সারা দেশে একই দামে সার পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, সরকারিভাবে দাম বাড়ানোর পরও নির্দিষ্ট মূল্যের বাড়তি দামেই সার কিনতে হচ্ছে। তাহলে পরবর্তী সময়ে উৎপাদন খরচ কী পরিমাণ বাড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এভাবে পুরো অর্থনীতিতে একটি বেসামাল অবস্থা তৈরি হওয়ার ক্ষণে সব দায় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর ওপর ছেড়ে দিলে আখেরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে চলে যাবে। এজন্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। দেশের উৎপাদন খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় সার ও জ্বালানি ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে হবে। আর জ্বালানি তেল নিয়ে বিশ্ববাজারের বিবেচনায় এ তথ্য উঠে আসছে যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এখন লাভ করছে। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে অকটেন, পেট্রল, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটারে এখন ৫ থেকে ১০ টাকা কমানোর সুযোগ আছে। এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি তেলের ওপর দুই ধরনের শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু যে কর কাঠামো করা হয়েছে, তাতে ব্যয় কমার কোনো আশা এ মুহূর্তে অবশিষ্ট নেই বলে বিপিসি সূত্রে জানা গেছে।

সাধারণত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দামে সরকার ভর্তুকি দেয়। কারণ এগুলোর দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, শিল্প খাত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারায়। যে কারণে জ্বালানিকে কৌশলগত পণ্য মনে করা হয়। এর ব্যবসাও সরকার নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল-জুনে গড় দামের তুলনায় চলতি বছর মে মাসে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৩৩ শতাংশ কমেছে। কিন্তু দেশে সরকার এখনো দাম কমায়নি; বরং উৎপাদনসংশ্লিষ্ট এ পণ্যে উচ্চ হারে কর আদায় করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎপাদনসংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের উদার নীতি গ্রহণ করা উচিত। না হলে অর্থনীতি ভীষণ সংকটে পড়ে যাবে। আমরা প্রত্যাশা করব, সরকার প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সার, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এতে খাদ্য অর্থনীতির সরবরাহ চেইন ও বাজার পরিস্থিতি সহনীয় থাকবে বলে আশা করা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন