মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৮৮, আহত অন্তত ৮০০ জন

ভুল সংকেতের কারণেই ঘটে ওড়িশার ট্রেন দুর্ঘটনা

বণিক বার্তা ডেস্ক

প্রাথমিক তদন্তে ভারতের ওড়িশার বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংকেত বিভ্রাটের তথ্য উঠে এসেছে ছবি: রয়টার্স

ভুল সংকেতের কারণে ভারতের ওড়িশার বালাসোরে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে দেশটির রেল কর্তৃপক্ষের তদন্ত দলের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে মূল লাইন দিয়ে চলে যাওয়ার সংকেত দেয়ার পর তা আবার তুলে নেয়া হয়। ট্রেনটি তখন স্টেশন এলাকার বাড়তি লাইনে (লুপ লাইন) ঢুকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনে আঘাত করে। তাতেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। 

এনডিটিভিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে কলকাতার হাওড়া থেকে চেন্নাইগামী একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। গত রাত ১টা পর্যন্ত পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় ২৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে আরো ৮০০ জন। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটের দিকে ভারতের ওড়িশায় বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার শিকার ট্রেনটি কলকাতার শালিমার স্টেশন থেকে চেন্নাইয়ের সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। পথে বালাসোর জেলায় একটি মালবাহী গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। 

এ ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে অন্তত দুজন বাংলাদেশী নাগরিক থাকার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনের মুখপাত্র রঞ্জন সেন। তিনি বণিক বার্তাকে জানান, আহত ওই দুই ব্যক্তির বাড়ি রাজশাহী ও বগুড়া জেলায়। তাদের নাম যথাক্রমে রাসেলুজ্জামান ও হাবিবুর রহমান। রাসেলের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি হটলাইনে জানিয়েছেন, রাসেল এখন ওড়িশার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাবিবুর রহমানের নাম পাওয়া গেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অফিস নবান্নের তালিকা থেকে।

রঞ্জন সেন বলেন, উপহাইকমিশনের পক্ষ থেকে এখনো আহত দুই ব্যক্তির বিষয়টি যাচাই করা যায়নি। তবে এরই মধ্যে উপহাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ওড়িশার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। তারা গেলে বাংলাদেশী কেউ হতাহত হয়েছেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

সাধারণত ট্রেন লাইনে যা দেখা যাচ্ছে তার বদলে লোকোমোটিভ (ট্রেনের ইঞ্জিন) চালকদের সিগন্যাল দ্বারাই বেশি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়, বিশেষ করে গাঢ় অন্ধকারের সময়ে। পরিদর্শন শেষে তদন্তকারীরা এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে প্রথমে একটি গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয় নির্ধারিত মূল লাইন দিয়ে যাওয়ার জন্য, তারপর আবার সেই সিগন্যাল তুলে নেয়া হয়। ততক্ষণে ট্রেনটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে একটি মালবাহী গাড়িকে ধাক্কা দেয় এবং লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। একই সময়ে ডাউন লাইন দিয়ে যশবন্তপুর এক্সপ্রেস ট্রেন চলে আসে এবং তারও দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। 

সেই বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, আমরা খুব সতর্কভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছি। তারপর সিদ্ধান্তে এসেছি যে আপ মেইন লাইনের জন্য প্রথমে করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে সিগন্যাল দেয়া হয়েছিল, তারপর আবার নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এ সময়েই ট্রেনটি আপ লুপ লাইনে প্রবেশ করে এবং মালবাহী গাড়িটিকে গিয়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে।

কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি এই বিষয়টি আরো তদন্ত করে দেখবে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা এখন সিগন্যালের ত্রুটি বা ব্যর্থতার দিকে বেশি নজর রাখছেন, পাশাপাশি ট্রেনচালকের বিষয়টিও দেখছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। কেন্দ্র ও রাজ্যের থাকা যথাসম্ভব উপকরণ দিয়ে টানা ১০ ঘণ্টা পর শনিবার সকালে বাহানগা বাজার রেলওয়ে স্টেশনে এ দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযান সম্পন্ন করা হয়। দুর্ঘটনাকবলিত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১ হাজার ২০০ যাত্রীকে দুটি বিশেষ ট্রেনে করে সরিয়ে নেয়া হয়। রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা বলেন, ‘‌উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। এখন পুনরুদ্ধার কাজ চলছে।’

শনিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা সবচেয়ে বড় এ দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘‌আমার দুঃখ প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। আহতদের সহায়তা দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার সরকার তার সবই করবে। যদি কেউ এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী প্রমাণিত হয়, তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

অন্যদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‌এখন রেলওয়ে বিভাগ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তারা যাত্রীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে মোটেও ভাবে না। পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। আমি যখন রেল মন্ত্রণালয়ে ছিলাম তখন সংঘর্ষবিরোধী ডিভাইস সেট করা হয়েছিল। এসব ডিভাইস থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না। আমার মূল অগ্রাধিকার যাত্রীদের উদ্ধার করা এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা।’

বর্তমান রেলমন্ত্রীকে পাশে রেখেই মমতা বলেন, ‘‌রেলওয়েতে এখন সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সেখানে বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আশঙ্কা করি এ দুর্ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।’

এ দুর্ঘটনার পর একদিনের শোক ঘোষণা করেছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পাটনায়েক। রেলমন্ত্রী অশ্বিনি বৈষ্ণব জানান, রেল দুর্ঘটনার তদন্ত করার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ১০ লাখ রুপির ক্ষতিপূরণও ঘোষণা করেন তিনি। এছাড়া গুরুতর আহতদের প্রত্যেকের জন্য ২ লাখ রুপি এবং কম আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপির ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন রেলমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদিও প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ২০ লাখ রুপি এবং আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন