সময়ের ভাবনা

অর্থ বনাম প্যাশন: ক্যারিয়ার বাছাইয়ের দ্বিধা অন্বেষণ

মো. আবিদ মঈন খান

যেকোনো চাকরির জন্য আবেদন ও নির্বাচন করার সময় বেতন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। তবে সাধারণত প্রায়ই মানুষ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের প্যাশন অর্থাৎ শক্তিশালী আবেগপূর্ণ অন্তর চাওয়াকে পূরণ করতে পারে—এমন কাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের আর্থিক চাহিদাগুলোকে পাল্লায় পরিমাপ করে থাকে। অর্থ জীবনের অত্যন্ত জরুরি, এটা অনস্বীকার্য। জীবন চালানোর খরচ শুধু আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে পার করে দেয়া কেবল অবাস্তব চিন্তা মাত্র। তবে কেবল অর্থের উদ্দেশ্যে ক্যারিয়ার নির্বাচন কখনই একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত পরিতৃপ্তি এনে দিতে পারে না। মানুষকে অর্থ ও প্যাশনের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে নিজের ক্যারিয়ার বেছে নেয়া উচিত। নিজের ভেতর থেকে কর্মস্পৃহা বৃদ্ধির তাড়না আনে প্যাশন, যা জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তিশালী অনুপ্রেরণা জোগায়। প্যাশন নিয়ে ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ রয়েছে—Follow your passion and success will follow you. জীবনে পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষের প্রায় সবাই নিজ নিজ প্যাশনকে খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই তারা জীবনে সফলতা অর্জন করতে পেরেছেন। তাই বাংলাদেশে ক্যারিয়ার বেছে নেয়ার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয়: ক্যারিয়ার নির্বাচনে আর্থিক লাভকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত নাকি নিজের ভেতরকার আবেগপূর্ণ চাওয়া অনুসরণ করা উচিত? যদিও কেউ কেউ এমন যুক্তি দেখান যে বাস্তবতার কারণে ক্যারিয়ারের পছন্দের পেছনে অর্থই একমাত্র প্রাথমিক চালিকাশক্তি হওয়া উচিত, কিন্তু অন্য অনেকেই বিশ্বাস করে যে একজনের আবেগপূর্ণ চাওয়া কাজের প্রতি অনুসরণ করা হলে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিপূর্ণতা এবং সাফল্যের দিকে পরিচালিত করে থাকে। বাংলাদেশের চাকরির বাজারের অনন্য প্রেক্ষাপট বিচারে অর্থ ও আবেগপূর্ণ চাওয়ার ভিত্তিতে ক্যারিয়ার বেছে নেয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কারণগুলো অন্বেষণ করাই এ লেখনীর লক্ষ্য। 

আর্থিক স্থিতিশীলতার তাৎপর্য: বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ক্যারিয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক স্থিতিশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে অনেকেই নিজেদের এবং তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য আয় এবং চাকরির নিরাপত্তাকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। আর্থিক স্থিতিশীলতা খোঁজার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বেতন, চাকরির বাজারে চাহিদা এবং বেতন বৃদ্ধির হার ও ক্যারিয়ারে অগ্রগতির সুযোগগুলোর মতো বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে।

এর সঙ্গে সামাজিক প্রত্যাশা ও চলমান সাংস্কৃতিক ধারা প্রায়ই ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষেত্রে আর্থিক সাফল্যের ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। এজন্যই পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাকাউন্টিং বা ফাইন্যান্সের মতো বিষয়গুলোয় ক্যারিয়ার গড়তে বেশি করে উৎসাহিত করে থাকে। কারণ এসব খাতে উচ্চ বেতনের সঙ্গে কাজের নিরাপত্তাও রয়েছে। ফলে ব্যক্তিরা তাদের আর্থিক সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ক্যারিয়ার বেছে নিতে প্ররোচিত হয়, এমনকি যদি তাদের আবেগপূর্ণ চাওয়া কাজ অন্য কোনো ক্ষেত্রেও থেকে থাকে।

আবেগপূর্ণ চাওয়া কাজের জন্য সাধনা: বর্তমানে করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন চলছে। এ অবস্থায় চাকরি পাওয়া যেমন সোনার হরিণ হয়ে গেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিন দিন চাকরির প্রতিযোগিতাও বেড়ে চলেছে। তবে এতকিছুর মধ্যে আর্থিক স্থিতিশীলতার গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ক্যারিয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আবেগপূর্ণ চাওয়া কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মানুষের মধ্যে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কারো আবেগপূর্ণ চাওয়াকে অনুসরণ করা হলে ব্যক্তির নিজস্ব প্রতিভা, আগ্রহ এবং নিজস্ব শক্তির ক্ষেত্রকে খুঁজে বের করা সম্ভব, যা বৃহত্তর ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা পেতে সহযোগিতা করে থাকে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে চ্যালেঞ্জগুলোকে কাটিয়ে উঠতে এবং নির্বাচিত কর্মক্ষেত্রে অবিচল থাকতে উৎসাহিত করে থাকে এবং নিজের কাজ থেকে অন্তর্নিহিত সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রেখে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্যারিয়ার বিকল্পের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সৃজনশীল শিল্প, উদ্যোক্তা, সামাজিক কাজ এবং প্রযুক্তি খাতগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। সমাজে অবদান রাখার সময় ব্যক্তিকে তার আবেগ অনুসরণের সুযোগ প্রদান করে। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে সমাজে অবদান রাখা এবং নিজেদের আবেগপূর্ণ চাওয়াকে অনুসরণের সুযোগ প্রদান করে থাকে। এ খাতগুলো উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন বৃদ্ধির পথ সরবরাহ করেছে, যা ব্যক্তিকে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

একটি মধ্যপন্থা খুঁজে বের করা: অর্থ ও আবেগপূর্ণ চাওয়া কাজের মধ্যে যেকোনো একটি নির্বাচন করে নেয়া অনেকটাই কেবল একটি সিদ্ধান্তের মতো মনে হতে পারে, তবে উভয় উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি মধ্যবর্তী ক্ষেত্র খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক স্থিতিশীলতা, আবেগপূর্ণ চাওয়া ও আগ্রহের মধ্যে সামঞ্জস্যতা একজন ব্যক্তির ক্যারিয়ারের তৈরির পথে জন্য অতীব জরুরি। তার জন্য একটি পদ্ধতি হলো, এমন ক্যারিয়ারগুলো অন্বেষণ করা যা ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতার সঙ্গে আর্থিক সম্ভাবনাকে একত্র করে। তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স, পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সৃজনশীল শিল্পের মতো বাংলাদেশের উদীয়মান ক্ষেত্রগুলোয় আর্থিক সাফল্যের সম্ভাবনা সরবরাহ করে এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন বৃদ্ধি এবং সৃজনশীলতা তৈরির সুযোগ প্রদান করে থাকে। উপরন্তু ব্যক্তি চাকরির খসড়া ধারণাটি বিবেচনা করতে পারে, যেখানে তার আবেগ এবং নিজস্ব কর্মশক্তির উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্তির জন্য তাদের কাজের পরিবেশ অনুযায়ী গুছানো ও রূপান্তর করা যাবে। নিজেদের আবেগপূর্ণ চাওয়া ও কাজের আগ্রহের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন প্রকল্প, পদ বা সংস্থাগুলো খোঁজার মাধ্যমে ব্যক্তি প্রচলিত ক্যারিয়ারের পথের মধ্যেও পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে পারে। 

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা এবং সব তথ্যে অবহিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বা আবেগপূর্ণ চাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ক্যারিয়ার বেছে নেয়া কম চ্যালেঞ্জের নয়। সীমিত আবেগপূর্ণ চাওয়ার মাধ্যমে পরিচালিত পেশার প্রাপ্যতা, সামাজিক প্রত্যাশা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা বাধা সৃষ্টি করতে পারে এমন ক্যারিয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা, পরিবারের সঙ্গে খোলামেলাভাবে যোগাযোগ এবং ক্যারিয়ার পরামর্শদাতা বা পরামর্শদাতাদের কাছ থেকে গাইডেন্স নেয়ার মাধ্যমে সাধারণ ব্যক্তি এ চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।

সম্ভাব্য ক্যারিয়ারের পথগুলোর বাস্তবসম্মত বোঝার জন্য সম্পূর্ণ গবেষণা অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট পেশার চাহিদা কেমন তা দেখা, বেতনের পরিসীমা কতটুকু এবং নির্দিষ্ট খাতের আয় বৃদ্ধির সুযোগগুলো অন্বেষণ করাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উপরন্তু ব্যক্তি ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ইন্টার্নশিপ বা খণ্ডকালীন চাকরি করতে পারে এবং একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার আগ্রহ এবং যোগ্যতার স্তর মূল্যায়ন করতে পারে।

পরিশেষে জাপানি একটি দর্শনের কথা বলে শেষ করতে চাই, যার মাধ্যমে ক্যারিয়ার বাছাই করা হলে অর্থ ও প্যাশনের মধ্যে একটি ভারসাম্য ফুটে ওঠে। এর নাম ইকিগাই, যা একটি জাপানি ধারণা। এর অর্থ হলো, কারো ‘Reason for being’ বা ‘হওয়ার কারণ’। জাপানি ভাষায় ‘ইকি’ মানে ‘জীবন’ এবং ‘গাই’ মানে ‘মূল্য’। অর্থাৎ ইকিগাই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য বা জীবনের প্রকৃত মূল্য। এটিই মানুষকে আনন্দ দেয় এবং প্রতিদিন কাজে যেতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। ইকিগাইয়ের ব্যাখ্যা বলছে যে একটি মানুষ তার স্বপ্নের ক্যারিয়ার খুঁজে পেয়েছে তখনই বলা যাবে, যখন তার কর্মজীবনে চারটি বৈশিষ্ট্যের সন্নিবেশ ঘটবে। আর সেই চার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— ক) আপনি কাজটিতে ভালো বা দক্ষ খ) আপনি কাজটিকে করতে ভালোবাসেন, গ) কাজটি বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ঘ) কাজটির আর্থিক মূল্য আছে। অর্থ বা আবেগপূর্ণ চাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ক্যারিয়ার বেছে নেয়া বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি দ্বিধাময় জায়গা। যদিও আর্থিক স্থিতিশীলতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে আবেগপূর্ণ চাওয়ার পেছনে অনুসরণ করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সফল ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারলেই একটি উজ্জ্বল ও ফলপ্রসূ সম্ভাবনা তৈরি হবে দেশের চাকরিবাজার ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য। আর সেজন্য উদীয়মান ক্ষেত্রগুলোকে অন্বেষণ করা প্রয়োজন।

মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন