মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রীও শঙ্কিত

নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনে কার্যকর ব্যবস্থাও নিন

প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি দুই অংক ছুঁই ছুঁই করছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে, তার কোনো নির্দেশনা বাজেটে নেই। মূল্যস্ফীতির আলোচ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এক ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বটে। অর্থমন্ত্রীর জন্য নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কেননা বাজেটে বড় ব্যয়ের পরিকল্পনা থাকলেও আয় বাড়ানোর বড় কোনো ব্যবস্থা নেই। আয়-ব্যয়ের প্রস্তাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, অর্জনের বাস্তবতা অপ্রতুল। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর যে আয়োজন অর্থমন্ত্রী করেছেন, তাতে মূল্যস্ফীতি না কমে বরং আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে।

বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢোকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণটা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে বলা যায়, শুধু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ। মূল্যস্ফীতির জন্য বড় আরেকটি কারণ হলো অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বড় ধরনের বৃদ্ধি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে কিছুটা প্রশমন করে দিতে হবে। সেটা করার অস্ত্র সরকারের কাছে আছে। একটি হলো বাজেট, অন্যটা মুদ্রানীতি। বাজেটে এবার অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রে যে শক্তিশালী প্রবণতা আছে, সেটিতে নতুন করে কিছু যোগ করা ঠিক হবে না। কৃত্রিমভাবে বাজারমূল্য বেঁধে দেয়া হলে বাজার তার নিজস্ব বিকল্পগুলো খুঁজে নেয়, এর ফলাফল কখনো শুভ হয় না। মূল্যস্ফীতি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি—এ দুটি কিন্তু একই সূত্রে গাঁথা। ডলারের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। চাহিদা বাড়ার পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমটা হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চিত একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি ও বড় বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না। আপৎকালে তারা সোনা ও ইউএস ডলারে বিনিয়োগ করছেন। সোনার জোগান সীমিত, তাই তারা ইউএস ডলারের দিকেই ঝুঁকছেন। দ্বিতীয়টা হলো, পণ্য আমদানিকারক দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে, সেখানে অর্থায়নের দরকার পড়ছে। সেখানেও ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার এখন গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার ও পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশেও আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় জোগান কমেছে। বাংলাদেশের রফতানি ঘুরে দাঁড়ালেও প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েছে। এ কারণে একটা ভারসাম্যহীনতা মুদ্রাবাজারে সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে গেলে গোড়ার কারণটায় হাত দিতে হবে। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিকে কীভাবে কমানো যায় এবং জোগান কীভাবে বাড়ানো যায় তা বের করতে হবে। এক্ষেত্রে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে বেঁধে দিয়ে কিংবা বাজারে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যভাবে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। একই দিনে একই ধরনের লেনদেনে ভিন্ন দরে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে। এটা বাজার ব্যবস্থাপনার বিরাট একটি সমস্যার নির্দেশক। বৈদেশিক মুদ্রার বাজার খুব পরিপক্ব বাজার। সেখানে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা কাম্য নয়।

বিশ্বের অনেক দেশ বটে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যমূল্য হ্রাসের আভাস মিলছে। জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, কমেছে খাদ্যপণ্যের মূল্য। কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের এখানে পণ্যের দাম বেশি। এ কথাও যে সর্বাংশে সত্য নয়, তার প্রমাণ চিনির দাম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে চিনির দাম প্রায় দ্বিগুণ। কোনো ব্যাখ্যাতেই এর হিসাব মিলছে না। ঠিক একইভাবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও আকাশচুম্বী। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষণায় কারসাজির বিষয়টি উঠে এসেছে। সরকার এটি বন্ধে সফলতা দেখাতে পারেনি। বাণিজ্যমন্ত্রীও সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় বলে মন্তব্য করেছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সেটি প্রশমনে দরিদ্র ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের মধ্যে স্বল্পমূল্যে খাদ্য কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি ও সমন্বিত উপায়ে তার বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিরাই যেন এর সুফল পায়, তাও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষণীয়।

দেশে কোনো খাদ্য সরবরাহ চেইনে সংকট নেই, বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য কমতির দিকে, দেশে কৃষি উৎপাদন ভালো হয়েছে, সম্প্রতি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, দরিদ্রের সহায়তা ও কষ্ট লাঘব এবং শিল্প-কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে গরিব মানুষের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রয়েছে। তবু কেন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে হচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি এবং অতি মুনাফাখোরি প্রবণতা। চাল, ডাল, তেল, চিনি প্রভৃতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে অনেকটা কার্টেল করে মূল্য নির্ধারণ করে। বাজারের এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কিংবা কঠোরভাবে মনিটর না করা হলে দেশের দ্রব্যমূল্য কমবে না। সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, অসৎ ব্যবসায়ীরা যেন রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবজি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ প্রভৃতি কৃষিজ দ্রব্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর প্রচেষ্টা নিয়ে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কের চাঁদাবাজি, পাইকারি ও খুচরা বাজারের বিভিন্ন সংগঠন ও এক শ্রেণীর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চেয়ে স্বল্পমেয়াদে পরিস্থিতির সমাধানে মনোযোগী হওয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিকে কীভাবে হ্রাস ও জোগান কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা বের করতে হবে। মূল্যস্ফীতির স্বাভাবিক স্তর ৫ শতাংশের নিচে না আনা পর্যন্ত গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মানুষকে নগদ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিতে হবে। ঝুঁকি মোকবেলার বড় হাতিয়ার হলো যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা। রিজার্ভকে সুরক্ষার জন্য কিছু অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে নগদ সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি ভাবা উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ভর্তুকি বাড়াতে গেলে বাজেট বাড়াতে হবে। ভর্তুকি কমাতে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ভর্তুকি দিতেই হবে। প্রয়োজনে বাজেটে অন্য জায়গা থেকে সাশ্রয় করতে হবে। জনগণের দৈনন্দিন জীবন সহজ ও পণ্যমূল্য সাধ্যের মধ্যে রাখতে প্রয়োজনে শ্রীলংকার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিতে পারি। শ্রীলংকার অপরিকল্পিত মেগা প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প চলমান। প্রকল্পের ঋণ শোধে যে আর্থিক চাপ সেটি সামাল দেয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিকল্পনা করে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এগোতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য বেড়ে গেছে। ব্যাহত হচ্ছে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান ডেভিড ম্যালপাস। এক্ষেত্রে দেশের খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। খাদ্য উৎপাদন, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য বিপণনের পথে বাধা দূর করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষি ও কৃষি সরঞ্জামাদি, কীটনাশক ও সারের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। 

অভিযোগ রয়েছে, বাজার পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশের কারণেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কারণেও নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। বস্তুত বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই মধ্যস্বত্বভোগীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ দুর্বলতা কাটাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হলো, সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হলেও তা কার্যকর হয় না। এতে ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। পণ্য ও সেবার দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেজন্য সরকারকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে সেসবের কার্যকারিতা। শুধু স্বীকার করলেই হবে না, উচ্চমূল্যস্ফীতি থেকে মানুষকে রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে। এখানেই ঘাটতি দৃশ্যমান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন