উপকূলের নদ-নদীতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ, দুর্দিনে জেলেরা

এম মিরাজ হোসাইন, বরিশাল ও মো. রাকিব হোসাইন রনি, লক্ষ্মীপুর

বরিশাল বিভাগসহ উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় হতাশ জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

জাটকা সংরক্ষণে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস উপকূলের কয়েকটি নদ-নদীর অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। তবে নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার ১৫ নদ-নদীতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। মৌসুমের শুরুতে সাগরে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় স্থানীয় নদ-নদীর ইলিশেই ভরসা এ অঞ্চলের জেলেদের। তবে এবার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। বরিশালের মেঘনা, কালাবদর, আড়িয়ালখাঁ, তেঁতুলিয়া, ইলিশা, কীর্তনখোলা, নয়াভাঙ্গুনী, সন্ধ্যা, পায়রা, কচা, আগুনমুখা, কারখানা, রামনাবাদ, আন্দারমানিক ও সুগন্ধাসহ ১৫ নদ-নদীর কোথাও দেখা মিলছে না ইলিশের। 

এখানকার আড়তদাররা জানান, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) এ তিন মাস ইলিশের প্রধান মৌসুম হলেও জ্যৈষ্ঠ মাসে নদ-নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলত। এবার ইলিশ নেই নদীতে। অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও সমুদ্র থেকে সারা বছর কম-বেশি ইলিশ আহরিত হয়। তবে এবার তার ভিন্ন চিত্র। নদীতে ইলিশ একেবারেই নেই। তাই জেলেরাও জাল ফেলে খালি হাতে ফিরছেন। তার ওপর ২০ মে-২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ শিকারে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে।    

হিজলার মেঘনা নদীর বাউশিয়া এলাকার জেলে আলী রাঢ়ী রাতভর নদী চষে বেড়িয়ে মাত্র ১৮০ টাকার ইলিশ বিক্রি করে ঘরে ফিরেছেন। তিনি বলেন, সারা রাত মেঘনা ও কালাবদর নদীর সংযোগস্থলে জাল ফেলে মাত্র দুটি ইলিশ পেয়েছি। সংসারের চাল কেনার টাকাও মেলেনি। তার ওপর আড়তদারদের ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে। এখন পেটের তাগিদে নদীতে জাল ফেলতে যেতে হচ্ছে। তাও লাভ হচ্ছে না।  

বৃহস্পতিবার সকালে বরিশালের পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে দেখা যায়, ইলিশশূন্য। অবশ্য জেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, মৌসুম শুরু হলেও সাগরে নিষেধাজ্ঞার কারণে এখনই ইলিশের দেখা মিলবে না। বর্ষা শুরু হলেই ইলিশ মিলবে নদ-নদীতে।  

বরিশালের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও আগের মতো কর্মব্যস্ততা নেই। শ্রমিক ও পাইকাররা চায়ের দোকানে বসে গল্প-আড্ডায় সময় পার করছেন। জেলেরা পুরনো ছেঁড়া জাল ঠিক করছেন। 

মৎস্য শ্রমিকরা বলেন, ‘সমুদ্রে মাছ শিকারে চলছে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। তাই বাজারে মাছ খুবই কম। দিনের বেশির ভাগ সময় অলস থাকতে হয়। আয় কম, সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। গত মাসের তুলনায় এ মাসে ইলিশের দাম বেড়েছে, আর কমেছে সরবরাহ।’

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে ৬০০ গ্রামের ইলিশ ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া এক কেজি সাইজের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ টাকা, এক কেজি ২০০ গ্রামের ১ হাজার ৮০০ টাকা ও দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকা কেজি দরে। ইলিশের দাম বেশি হওয়ায় নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতাদের। 

হিজলার পাইকারি ইলিশ ব্যবসায়ী মো. আফসার উদ্দিন বলেন, ‘মেঘনা ও কালাবদর নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে না। তাই বাজারে নদীর ইলিশের দেখা মিলছে না।’ 

মৎস্যজীবী লীগের বরিশাল মহানগর সভাপতি ও ত্রিশাল আড়তের স্বত্বাধিকারী খান হাবিব বলেন, ‘আগে প্রতিদিন ১-২ হাজার মণ ইলিশ এলেও এখন ৩০-৪০ মণও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসার অবস্থা ভালো না। আর ইলিশ বাজারে না থাকায় দামটা একটু বেশি।’ 

বরিশাল জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘নদীতে ডিম ছেড়ে ইলিশ সমুদ্রে চলে যায়। এ সময় নদ-নদীতে তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। তবে বাজারে অন্যান্য মাছের প্রচুর সরবরাহ আছে।’

বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার জানান, বরিশালের সব মৎস্য মোকাম ইলিশশূন্য। নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি আশা করেন বৃষ্টির দেখা মিললেই সংকট কেটে যাবে। 

এদিকে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায়ও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। সারা দিন নদীতে জাল ফেলেও দেখা মিলছে না রূপালি ইলিশের। ইলিশ না পেয়ে জেলেদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। এতে জেলে পল্লীগুলোয় বিরাজ করছে হতাশা। মাছ ঘাটগুলোয় ইলিশসহ অন্যান্য মাছের আমদানি কম থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্য ব্যাবসায়ী ও আড়তদাররা। 

মৎস্য বিভাগ বলছে, সমুদ্র থেকে মেঘনায় প্রবেশ পথ নোয়াখালীর হাতিয়া, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচর। এতে সমুদ্র থেকে মেঘনায় আসা-যাওয়ায় বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ইলিশ ফিরে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে মেঘনায় ইলিশ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যে দেখা যায়,  লক্ষ্মীপুরে মেঘনায় মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৫১ হাজার ১২১ জন জেলে। সরকারি নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৪৯ জন। এছাড়া সমুদ্রগামী জেলে রয়েছেন দুই লক্ষাধিক। জেলার চারটি উপজেলায় ২৬টি ইলিশের মাছঘাট রয়েছে। জেলায় চলতি বছর ২৮ হাজার টন ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর ইলিশের উৎপাদন নিয়ে শংকিত সংশ্লিষ্টরা।    

স্থানীয়রা জানান, জাটকা সংরক্ষণে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস মেঘনার অভয়াশ্রমে সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ ছিল। সরকারের নির্দেশনা পালনের পর আবারো নদীতে জাল হাতে মাছ ধরতে নামেন লক্ষ্মীপুরের জেলেরা। কিন্তু এখন ইলিশের মৌসুম হলেও লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেদের জালে দেখা মিলছে না রূপালি ইলিশ। এতে করে চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন কয়েক হাজার জেলে পরিবার। প্রতিদিন ১০-১২ জন জেলে এক-একটি নৌকা নিয়ে নদীতে গিয়ে ঘাটে ফিরছেন দু-চারটি ইলিশ নিয়ে। আবার কেউ ফিরছেন শূন্য হাতে। ফলে দৈনন্দিন ব্যয়ের তুলনায় আয় না হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন জেলার প্রায় ৬৫ হাজার জেলে। 

কমলনগর উপজেলার লুধুয়া ঘাট এলাকার আবুল কাশেম, রামগতি ঘাটের নিজাম উদ্দিনসহ কয়েকজন জেলে জানান, নিষেধাজ্ঞাকালীন আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। এখন ইলিশের ভরা মৌসুমও মিলছে না ইলিশ। প্রতিদিন নদীতে যেতে নৌকা ভেদে তাদের খরচ হয় ছয়-সাত হাজার টাকা। কিন্তু খরচের টাকার মাছও পান না তারা। এতে আর্থিক সংকটে পড়ে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার মতিরহাট মাছ ঘাটের আড়তদার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আগে এ সময়ে লাখ লাখ টাকার ইলিশ কেনাবেচা হতো। এখন খালি বাক্স নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। লাখ লাখ টাকা জেলেদের দাদন দিয়েছি। জেলেরা নদীতে মাছ না পাওয়ায় ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নাব্যতা সংকট ও জলবায়ু প্রভাবে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় আশানুরূপ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এখানকার আহরিত ইলিশের ৭০-৮০ ভাগই সামুদ্রিক ইলিশ। ডুবোচরগুলো চিহ্নিত করে খননের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলা হচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন