বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩

বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি

বদরুল আলম

দেশের অর্থনীতিতে ছোট শিল্পগুলোর অবদান মূলত নিজেদের টিকিয়ে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে সচল রেখে আরো এগিয়ে নিচ্ছে বৃহৎ শিল্পগুলোই। তবে জ্বালানি সংকট, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং উৎপাদন সক্ষমতা কমায় ব্যবসার চাপে রয়েছে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ চাপে থাকাটা অর্থনীতির জন্য ভালো ইঙ্গিত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বৃহৎ শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সার্ভে অব ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজের (এসএমআই) তথ্য বলছে, দেশে মোট ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প সংখ্যা ৪৬ হাজার ১১০। এর মধ্যে বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প সংখ্যা ২ হাজার ৮৫৬। এ বৃহৎ শিল্পগুলোর অবদান দেশের মোট উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি। যার হার ৬৭ শতাংশ।

শিল্প নীতি ২০১০ অনুযায়ী, কোনো শিল্পে ১০ থেকে ২০ জন ব্যক্তি সম্পৃক্ত থাকলে তা অতিক্ষুদ্র। সম্পৃক্ত মানুষের সংখ্যা ২৫ থেকে ৯৯ হলে তা ক্ষুদ্র এবং ১০০ থেকে ২৫০ জন হলে মাঝারি শিল্প। আর ২৫০ জনের বেশি ব্যক্তির সম্পৃক্ততা থাকলে তাকে বৃহৎ শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সংখ্যার বিবেচনায় দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পের বড় অংশজুড়ে আছে ছোট (অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র) শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবহার থেকে শুরু করে রাজস্ব সব ক্ষেত্রেই অবদান বেশি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের। শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের কম-বেশি সব শিল্প খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা চাপের মধ্যে রয়েছে। জ্বালানি সংকট, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং চাহিদা সবকিছুর বিবেচনায় উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ অব্যবহৃত থাকছে। এ অবস্থায় শিল্প টিকিয়ে রাখতে হিমশিম বেশি খেতে হচ্ছে বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোকে।

মূলত পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত দাঁড়িয়ে আছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিল্পোদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে বৈচিত্র্য এসেছে। খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। পোশাক খাতের পাশাপাশি সম্প্রসারিত হচ্ছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, কাঠ ও কাঠজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাসায়নিক, প্লাস্টিক পণ্য, গ্লাস, স্টিল, সাধারণ ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র এবং পরিবহন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন কার্যক্রম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এরই মধ্যে কমেছে। ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিও দেখা যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে। খাদ্যপণ্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ১১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

কোমল পানীয় ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ৫২ শতাংশ। সমাপ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ২৪ শতাংশে। দেশের তৈরি পোশাক পণ্যের কাঁচামাল সুতা-কাপড় উৎপাদনকারী বস্ত্র শিল্পের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ২৬ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল ৪৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ঋণাত্মক ১ শতাংশ। ওষুধ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৮ শতাংশে। মৌলিক ধাতু ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৪ শতাংশ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেমে এসেছে ১১ শতাংশে। 

শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব বিবেচনায় আগামীতে বৃহৎ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এ পরিস্থিতি সহনীয় করে শিল্প খাতের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

ওষুধ পণ্য উৎপাদনকারী দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু বিষয় কাজ করেছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। টাকার অবমূল্যায়ন ও বিদেশী মুদ্রার অপ্রতুলতার কারণে রফতানি ও অভ্যন্তরীণ বাজারে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমরা আশাবাদী, কারণ ধীরগতিতে হলেও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তা দুঃখজনক। নতুন অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রভাব কী হয় সেটাও ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ধরনের হিসাবনিকাশ কাজ করছে। যেগুলো মানুষের আস্থাকে প্রভাবিত করবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে সে ভাবনাও রয়েছে। সবদিক থেকেই মানুষের আস্থার জায়গাটা এখন পর্যন্ত কম। এ বিষয়গুলো সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে কাজ করছে। আমরা আশা করছি, বর্তমান পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাবে। একেবারে মসৃণ পথ কখনই হয় না। বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে সবদিকেই প্রতিকূলতা রয়েছে। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসাবান্ধব তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। হতাশার বিষয় হলো চাপটা সবসময়ই বেশি মোকাবেলা করতে হয় বৃহৎ শিল্পকে। যা দিনে দিনে বাড়ছে।’

শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, গত দুই দশকে অর্থনীতির রূপান্তরে মূল ভূমিকা ছিল উৎপাদনমুখী শিল্পের। এ সময়ে উৎপাদনমুখী খাত শুধু বড় হয়নি, বৈচিত্র্যও এসেছে। সব মিলিয়ে উৎপাদনমুখী শিল্পের আকার ক্রমেই বড় হয়েছে। শিল্পোদ্যোগ সফল করতে সহায়তা করেছে সরকারের নীতি। যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের মতো অবকাঠামোয় সরকারের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এখন জ্বালানি নিয়ে অনিশ্চয়তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আবার করের কাঠামোগত জটিলতার পাশাপাশি রয়েছে করের চাপও। এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে উৎপাদনমুখী শিল্প অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি একটা শ্লথতার মধ্যে রয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরেই এ পরিস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যেও চলতি অর্থবছর শেষে যদি ৮ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়, সেটা ভালো। কারণ সবকিছুর দাম বেড়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার প্রক্ষেপণে আমি বিস্মিত। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় অনুমান ছিল, প্রবৃদ্ধি অন্তত ৪ শতাংশ কমেছে। আগামী বছর প্রবৃদ্ধি যে নেতিবাচক হবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। প্রবৃদ্ধি যখন ধারাবাহিকভাবে নামতে থাকে তখন তৃতীয় বর্ষটা খুব চ্যালেঞ্জিং হয়। আমরা এখন নিম্নমুখিতার তৃতীয় বর্ষে রয়েছি। চতুর্থ বর্ষ থেকে হয়তো আবার প্রবৃদ্ধি বাড়ন্ত হতে পারে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ভালো নয়। ধরেন সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নেই, তাহলে শিল্পে প্রবৃদ্ধি হবে কী করে?’

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব কারণে ম্যানুফ্যাকচারিং প্রবৃদ্ধিতে শ্লথতা এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম, যেমন কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরাসহ বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তারা দেখছেন যে তাদের পণ্যের প্রবৃদ্ধি নেই এবং নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে যে অনেক পণ্যের দাম কমেছে, তার প্রতিফলনও দেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ অর্থবছরে সামগ্রিকভাবে যে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে তা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফও প্রক্ষেপণ করেছে। এমনকি সরকারও এ নিম্নমুখিতায় ব্যক্তি খাতকে সমন্বয় করেছে। চলতি অর্থবছর প্রায় শেষ, এ অর্থবছরে নম্বর যাই আসুক, আমি শঙ্কিত আগামী অর্থবছর নিয়ে। যে প্রবণতা রয়েছে, অর্থনীতিতে এমন কিছু চিহ্ন  দেখতে পাচ্ছি না যেটা নিয়ে ধারণা করা যায় যে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। পাশাপাশি ইতিবাচক পরিবর্তন হয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারে। কারণ রফতানির জন্য খুব ভালো কোনো খবর আছে তা নয়, প্রধান বাজারগুলোতে রফতানি এরই মধ্যে নেতিবাচক দেখা যাচ্ছে। সুতরাং শঙ্কা হলো সামনের অর্থবছরে বর্তমান প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির দিকে হাঁটতে হতে পারে। যদিও বাজেটে এমন চিত্র দেয়া হয়েছে যেটাতে মনে হতে পারে যে ব্যক্তি খাতে নাটকীয় উন্নয়ন হবে, যার দরুন প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৭ শতাংশ।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন