সিপিডির বাজেট পর্যালোচনা

বাস্তবতার সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের মিল নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উচ্চাকাঙ্ক্ষী, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ বাজেট বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন এবং বাস্তবায়ন হবে না বলেই মনে করে সংস্থাটি। গতকাল রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে আয়োজিত জাতীয় বাজেট পর্যালোচনায় এসব তথ্য তুলে ধরে সিপিডি। 

মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

সিপিডির বাজেট পর্যালোচনায় ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘চলমান অর্থনীতির চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এ বাজেট অনেকাংশে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আনার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করাও চ্যালেঞ্জিং হবে। এছাড়া বাজেটে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিতে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। আমরা অনেক কিছু আমদানি করে থাকি কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম নিম্নমুখী। আমাদের অভ্যন্তরীণ অনেক দুর্বলতা রয়েছে। একদিকে কর কাঠামো অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে। বাজারে কারসাজিও হয়।’ 

তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এটারও প্রভাব রয়েছে মূল্যস্ফীতির ওপর। মুদ্রানীতির সঙ্গে আর্থিক নীতির সমন্বয় না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হবে। চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো পুরোপুরি অনুধাবন, গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে প্রস্তাবিত বাজেট অপর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাজেটের এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রফতানি ইত্যাদি যা ছিল তার থেকে প্রক্ষেপণ অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির যে কাঠামো বাজেটে দেয়া হয়েছে তাতে বর্তমান অবস্থার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।’ 

এছাড়া অনেক লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে আইএমএফের চাওয়া পরিপালনের চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, ‘আইএমএফের চাওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রতিফলন হয়েছে রাজস্বে। রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা তা সরকারি ব্যয়ের চেয়ে বেশি পরিমাণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এবার এনবিআর থেকে কর আদায়ের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ঘাটতির ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থায়ন হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এছাড়া ব্যাংক থেকে ধার নেয়া হবে ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর ফলে টাকা ছাপানো হবে, যা মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করে। আগামী অর্থবছরেও যদি এটা অব্যাহত থাকে তাহলে তা মূল্যস্ফীতির জন্য ভালো হবে না।’ 

টিনধারীদের ন্যূনতম করের কোনো যৌক্তিকতা নেই উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সরকারের ৩৮টি সেবা নিতে হলে টিন লাগবে। টিনধারীর করযোগ্য আয় না থাকলেও এই ৩৮ সেবা নিতে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলো মানুষকে স্বস্তি দেয়ার জন্য, আবার যার করযোগ্য আয় নেই তাকে কর দিতে হবে, এটা সাংঘর্ষিক। এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এছাড়া সারচার্জের সীমা ৩ কোটি থেকে ৪ কোটিতে বাড়ানো হয়েছে, যা অস্বাভাবিক। জাস্টিফায়েড কর ব্যবস্থার জন্য তা গ্রহণযোগ্য না। এছাড়া গাড়ির ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সারচার্জ বসানো ভালো উদ্যোগ। এটা রাজস্ব আয় বাড়াতে এবং পরিবেশ ক্ষতি কমিয়ে আনতে কাজ করবে।’ 

তিনি বলেন, ‘সরকারের বর্তমান মেয়াদে শেষ বাজেট এটি। এ বাজেটে কঠিন কিছু ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু তা হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ ধরনের চাপ রয়েছে। এর মধ্যে রাজস্ব আয় কম হয়েছে, সরকারি ব্যয়ও এক জায়গায় স্থবির হয়ে রয়েছে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে গেছে, যা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে।’ 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাতওয়ারি উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ কমেছে। কিন্তু অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে। অনুন্নয়ন ব্যয় হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যয় ও পরিচালনা ব্যয়। এটা যত কম রাখতে পারি সেটাই আমাদের দক্ষতার প্রমাণ। এছাড়া অন্যান্য স্বল্পোন্নত ৪৪ দেশের চেয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম। যার ফলে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

সিপিডি তাদের পর্যালোচনায় আরো জানায়, বাজেটে কৃষি খাতের জন্য সরকারি ব্যয়ের বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি কমেছে। কৃষি খাত আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমরা বাজেট করেছিলাম বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়েই। নতুন অর্থবছরের বাজেটেও আমাদের অর্থনীতিতে যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে সেই অনুমিতি বিবেচনা না করলে পরবর্তী সময়ে আবার হোঁচট খেতে হবে।’ 

গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘অনুদাননির্ভর ও সরকারের সাহায্যনির্ভর পুঁজিবাজার বেশি দিন টিকতে পারে না। এছাড়া আইএমএফের শর্তেও পুঁজিবাজার নিয়ে বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই। এবারের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ ঘোষণা করতে না পারা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে এ বাজেট ব্যর্থ হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন