২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অর্থমন্ত্রীর

মানুষ ও অর্থনীতির ওপর চাপ আরো বাড়াবে

বড় চিত্রটি অস্পষ্ট। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। কাজেই খরচ বাড়ানোর জন্য ‘জনমোহিনী’ চাপ ছিলই। একটা বিপরীত চাপও ছিল, ঘাটতি কমানোর। প্রত্যেক বাজেট বক্তৃতায় যেমনটা দস্তুর, এ বক্তৃতায়ও তেমনই বহু ঘোষণা ছিল হরেক প্রকল্প এবং ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা। সরকারের আয় কম, ব্যয়ের চাপ বেশি। জ্বালানি ও ডলার–সংকটে ব্যবসায়ীরা বিপাকে, মূল্যস্ফীতির চাপে সীমিত আয়ের মানুষ। গত বছরের বাজেটে যে খাতে যত টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, বহু ক্ষেত্রেই আসলে তার তুলনায় কম টাকা খরচ হয়েছে। ফলে গত বছরের বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে এবারের বাজেট বরাদ্দের তুলনা করলে দেখা যাবে, আসলে অর্থমন্ত্রী যতটা দেখাতে চাইছেন, বরাদ্দ ততটা বাড়েনি। বৃদ্ধির উচ্চতর কক্ষপথে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন এবং ভোগ ব্যয় ও বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে তার ব্যবস্থা করাও দরকার। কথাটির যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু এ বাজেট সেই কাজটি করবে—এমন প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক। প্রস্তাবিত বাজেটে বড় ব্যয়ের পরিকল্পনা আছে, কিন্তু আয় বাড়ানোর বড় ব্যবস্থা নেই। আয়-ব্যয়ের প্রস্তাবে কল্পনা আছে, অর্জনের বাস্তবতা কম।

অর্থমন্ত্রী নতুন যে বাজেট দিয়েছেন, তা সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দিয়েছেন তা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। অথচ গত এপ্রিল পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে মোট লক্ষ্যের মাত্র ৬১ শতাংশ। বিদ্যমান ডলার–সংকট এবং আমদানিতে নানা বিধিনিষেধ থাকায় এ রাজস্ব আদায় নতুন অর্থবছরে কী করে বাড়বে তা পরিষ্কার নয়। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির হাল তো আরো খারাপ, বাস্তবায়নের হার গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন—মাত্র ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আবার নতুন অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ করার যে লক্ষ্য ঠিক হয়েছে, তা প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। সুতরাং সুদ পরিশোধের চাপও বাড়বে। নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের বিপদ বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সময় অর্থমন্ত্রী বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন। কারণ চাইলেও অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যয় করতে পারেননি। ফলে অর্থ ধার করতে হয়েছে। তাই বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে সুদ পরিশোধে। এছাড়া বেশি অর্থ ব্যয় হয় ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে—সাড়ে ২০ শতাংশ। ব্যয়ের আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সরকারি খাতে বেতন ও ভাতা। এর হার প্রায় ১৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ডলার–সংকট, আমদানি হ্রাস, উৎপাদন কম ইত্যাদি কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। তার পরও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়ে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার স্বপ্ন আছে, যা এখন ৯ শতাংশের বেশি। একই সময়ে অর্থমন্ত্রীর আরেকটি প্রত্যাশা হচ্ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাজেট বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। 

বাজেটে কিছু ইতিবাচক দিক আছে। যেমন– যে কর প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে সিগারেট থেকে অতিরিক্ত অর্থ আসতে পারে। এ করারোপ স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। দ্বিতীয়ত, গাড়ি কেনার জন্য করহার বাড়ানো হয়েছে। এটাও ভালো দিক। যানজট বা বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ। সার্বিকভাবে মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়বে প্রস্তাবিত বাজেটে। সাধারণত নির্বাচনী বছরের বাজেটে জনতুষ্ট অনেক কর্মসূচি নেয়া হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় নানা প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ থাকে, নানাভাবে মানুষের হাতে টাকা দেয়ার পথ খুঁজে বের করা হয়, ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার দৃশ্যমান প্রস্তাব রাখা হয়, দেয়া হয় নানা করছাড়। সামাজিক নিরাপত্তার নামে বরাদ্দও বাড়ানো হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে এ রকম কিছু নেই বললেই চলে। বরং আমদানি পণ্যে ব্যাপকভাবে সম্পূরক শুল্ক আরোপ, ২ হাজার টাকা ন্যূনতম কর দেয়ার বিধান, জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ব্যয়ের অসহনীয় বৃদ্ধি, দ্বিতীয় গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কর আরোপের মতো ব্যবস্থার কথা রয়েছে। স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী, একই সঙ্গে অনেক আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের বিপাকেও ফেলেছেন। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় অর্থমন্ত্রী ব্যক্তিশ্রেণীর ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে করেছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আবার সরকারি সেবা নিতে হলে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতেই হবে, করযোগ্য আয় না থাকলেও। সম্পদের ওপর সারচার্জের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এ ধরনের কিছু বিষয় করের ন্যায্যতার নীতির সঙ্গেও যায় না। নানা ধরনের গৃহস্থালি সামগ্রী, আমদানি করা বাদাম, খেজুর, এলপিজি সিলিন্ডারের গ্যাস, এমনকি টিস্যু বা ন্যাপকিনের মতো পণ্যেরও দাম এবার বাড়বে।

জ্বালানি সংকটে ভুগছে দেশ। গ্যাস-কয়লার অভাবে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বেড়েছে লোডশেডিং। গ্যাস সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। ডলার সংকটে গ্যাস-কয়লা আমদানি বন্ধ থাকছে। সংকট সামলাতে বিশেষজ্ঞরা দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিতে বলছেন। তবে বরাবরের মতো বাজেটে অবহেলিত থাকছে জ্বালানি খাত। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছে। অথচ দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ছিল জরুরি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে প্রস্তাবিত বাজেট তেমন ভূমিকা রাখবে না। যে নীতি আর্থিক প্রবৃদ্ধির দিকে ঝুঁকে থাকে, তা দ্রুত বিনিয়োগবান্ধব ও দারিদ্র্যবিরোধী নীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষকে দারিদ্র্যের বাইরে নিয়ে আসতে হলে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। সে জন্য প্রবৃদ্ধির বিকল্প নেই। অতএব শিল্পবান্ধব বা ব্যবসাবান্ধব নীতি দরিদ্রবান্ধবও বটে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্রবহুল দেশে শুধু আর্থিক প্রবৃদ্ধি দিয়েই অন্তত অদূরভবিষ্যতে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান করে ফেলা যাবে না, সে কথা অনস্বীকার্য। গরিবের জন্য খাদ্যে ভর্তুকি বা অপেক্ষাকৃত কম কর্মসংস্থানের সময়গুলোয় নিশ্চিত কাজের ব্যবস্থা জরুরি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই, মানুষের ভালো করাটাই আসল কথা—সরকার এ প্রাথমিক সত্যটা ভুলে যায়। ঘটনা হলো, আয় যথেষ্ট না বাড়লে রাজস্ব বাড়ে না, রাজস্ব না বাড়লে সরকারের পক্ষে সামাজিক কল্যাণের জন্য যথেষ্ট ব্যয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। সুতরাং অন্য সব কারণ ছেড়ে দিলেও কেবল সামাজিক ব্যয় বাড়ানোর জন্যও জিডিপির যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি জরুরি। তবে তার বণ্টনটাও হতে হবে সুবিন্যস্ত।

প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যয় কাঠামো। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণ খুব দরকার ছিল। যেসব ব্যয় কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না, সেগুলো বাদ দেয়া বা কমানো দরকার ছিল। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। এডিপিতেও গতানুগতিক বরাদ্দ আছে। সেখানেও ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণ ঘটেনি। বর্তমান সময়ে যেসব বিষয় অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা বাজেট প্রস্তাবে অনুপস্থিত। বাজেটের মাধ্যমে যে ধরনের সংস্কারের সুযোগ ছিল, তা-ও নেই। সামষ্টিকভাবে বাজেটটি সম্প্রসারণমূলক। কারণ বাজেটে ঘাটতি প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। সেটা চলতি অর্থবছরের চেয়ে অনেক বেশি। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে (এডিপি) বরাদ্দের কাছাকাছি। এডিপি বিশাল, বাজেট ঘাটতিও বিশাল। এ বাজেট অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক হতো, কিন্তু আমরা পুরো উল্টো পরিস্থিতিতে আছি। মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে, ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। গত অর্থবছরে ৭০০ কোটি ডলার ও চলতি অর্থবছরে ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ সঠিকভাবে হিসাব করলে ব্যবহারযোগ্য হবে ২ হাজার কোটি ডলারের মতো; যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের চেয়ে বেশ কম। এখন যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তা স্বাভাবিকভাবে রিজার্ভ বাড়বে—এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই। এ অবস্থায় সম্প্রসারণমূলক বাজেট মঙ্গল বয়ে আনবে না। মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ওপর এ বাজেট ঘাটতি কতটা চাপ ফেলবে, তা নির্ভর করছে ঘাটতি কোথা থেকে মেটানো হবে তার ওপর। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির বড় অংশ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে নেয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরেও এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতির জন্য তা হবে ভয়ংকর। যদি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার এ টাকা ধার নেয়, তাতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কম হবে। এখন স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদও ৮ শতাংশের মতো। ব্যাংকাররা এটা পছন্দ করবেন, কারণ এটা নিরাপদ বিনিয়োগ। এখন ডলার সংকটের কারণে বিনিয়োগ চাহিদা কম, কিন্তু চাহিদা একেবারেই নেই, এটা ঠিক নয়। ব্যাংকের টাকা ব্যবসায় গেলে কর্মসংস্থান হতো, যা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখত। সরকার ব্যাংক থেকে অর্থ নিলে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে, তার কোনো সমাধান বাজেটে মিলছে না। আবার ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। অনেক ব্যাংকে আমানত কমেছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও কমেছে। ডলার কেনার কারণে অনেক টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে গেছে। এ অবস্থায় সরকার যদি বাজেটের ঘাটতির ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলো থেকে নেয়, তাহলে সেই টাকা বিনিয়োগের বাইরে থেকে যাবে। রাজস্ব ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন ছিল, তা-ও হচ্ছে না। সরকার অনেক দিন ধরে বলে আসছে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের দিকে যেতে চায়। অর্থমন্ত্রী প্রত্যক্ষ করের অংশ ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশে নিতে চান। কিন্তু যে বাজেট দেয়া হয়েছে, তাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতাই বেশি। ফলে যা বলা হচ্ছে, আর যা করা হচ্ছে, তা এক নয়। বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে পরিকল্পনা দেয়া হলো, তা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গেও মিল নেই। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন