চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন মাত্র ৪৫ শতাংশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের নির্ধারিত আকার রয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যদিও পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটের আকার কিছুটা কমিয়ে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা করা হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাজেটের মাত্র ৪৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। সংশোধিত বাজেট বিচেনায় নিলে এর পরিমাণ ৪৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। 

গতকাল জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নকালীন প্রাক্কলিত নামিক মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। এর ১৫ দশমিক ২ শতাংশ হিসাবে চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট নির্ধারণ করা হয়। সংশোধিত বাজেট করার সময় সাময়িক হিসাবে জিডিপি দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। জিডিপির অনুপাতে সংশোধিত বাজেটের আকার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ বা ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাস্তবায়িত বাজেটের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন আবর্তক ব্যয় বাবদ ৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৮৫ কোটি টাকা করা হয়। যদিও চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। একইভাবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে ২ লাখ ৪১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা দাঁড়ায়। তবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এ খাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা নির্ধারিত থাকলেও সংশোধিত বাজেটে এটি ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও এ বছরের মার্চ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যয় খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৪৫ হাজার ২০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে এটি কমে ২৮ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থবছরের নয় মাস শেষে এ খাতে ১৬ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা এটা বলতে পারি যে বাজেট বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধিও অনেক কম হওয়ার কথা। কারণ স্বল্প সময়ে বেশি অর্থ ব্যয় করলে সেটির গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পাশাপাশি তা মূল্যস্ফীতিকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। গত ৮ থেকে ১০ বছরের চিত্র থেকে দেখা যায়, আমরা বাজেটের ৭৭ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যয় করতে পারিনি। এবার হয়তো আরো কম হবে। প্রায় সব প্রকল্পেই কিছু না কিছু বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যয় আছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সরকারকে এক্ষেত্রে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরে আমাদের ব্যয় সক্ষমতা দুর্বল ছিল। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়েও শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতি হয়তো বড় মাত্রায় মন্দার মুখে পড়েছে। পুরো অর্থবছরের পরিসংখ্যান যখন পাওয়া পাবে তখন আমরা প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বিশদভাবে জানতে পারব।’ 

চলতি অর্থবছরের জন্য মোট ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় নির্ধারিত রয়েছে। সংশোধিত বাজেটেও এর পরিমাণও একই ছিল। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি বাবদ ৪৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। চলতি অর্থবছরের নয় মাস শেষে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে ৬ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ২৭ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। 

রাজস্ব আয় দিয়ে পুরো ব্যয় সংস্থান করা সম্ভব না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যদিও সংশোধিত বাজেটে এ ঘাটতি কিছুটা কমিয়ে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর এ বছরের মার্চ শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে সরকারকে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ৮৭ হাজার ৮২ কোটি টাকা করা হয়। যদিও চলতি অর্থবছরের নয় মাসে ৮ হাজার ৮৫১ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ করেছে সরকার।

এ সম্পর্কে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগের বছরগুলোর যে প্রবণতা সেটি থেকে চলতি অর্থবছরের বাজেট ভিন্ন কিছু নয়। দেখা যায়, শেষ তিন মাসে গিয়েই বড় ধরনের খরচগুলো হয়। এ খরচ করতে গিয়ে খুব বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা থাকে না। প্রকল্প কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তারচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার থাকে অর্থ খরচ করার। এ ধরনের প্রবণতা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। চলতি অর্থবছরের নয় মাসের পরিসংখ্যানে আমরা যেটা দেখেছি তাতে আশঙ্কা হচ্ছে এবার রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে। এর অর্থ হচ্ছে বাজেটের অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হবে না, কারণ হাতে টাকা নেই। অর্থবছর শেষে গিয়ে এক্ষেত্রে কাটছাঁট হবে। তখন দেখা যাবে খুব একটা পদ্ধতিগত কিংবা বৈজ্ঞানিক উপায়ে যে এ কাটছাঁট হবে তা কিন্তু নয়। বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো খাত থেকেই সেটি করা হবে। আগামী অর্থবছরের যে বাজেট আজ উপস্থাপিত হয়েছে সেখানেও এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এটি বাজেটের বড় ধরনের দুর্বলতা এবং সেটি কাটানোর কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায় না।’

চলতি অর্থবছরের বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা কিছুটা কমিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়। এ বছরের মার্চ শেষে এ খাতে ২৪ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই আসে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ১৭২ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়েছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন