নতুন বাজেটে একগুচ্ছ শুল্ক ও ভ্যাট প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন বাজেট ঘোষণার পর সাধারণত দেখা যায় বেশকিছু পণ্যের দামের পরিবর্তন ঘটে। নতুন করে শুল্ক ও কর আরোপ করলে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আবার প্রত্যাহার করলে সেসব পণ্যের দাম কমতে দেখা যায়। তাই নতুন বাজেটের এ অংশ ঘিরে সাধারণ মানুষের বেশ আগ্রহ থাকে। কেননা আইন অনুযায়ী, বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আমদানি শুল্ক ও করসংক্রান্ত প্রস্তাব কার্যকর হয়ে যায়। 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও বেশকিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। গতকাল বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ পরিবর্তনগুলো কার্যকর হয়ে গেছে। ফলে এখন থেকে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, মূসকের নতুন হার প্রযোজ্য হবে। প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস অ্যাক্ট, ১৯৩১ সালের ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বাজেটের প্রস্তাবগুলো কার্যকর করা হয়েছে। 

প্রতিবারই অর্থ বিলে প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস অ্যাক্টের কথা উল্লেখ করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাবগুলো কার্যকর করার ঘোষণা দেয়া হয়। অর্থ বিলের শেষাংশে এ কার্যকর করার ঘোষণাটি থাকে। তবে বাজেটের আয়করসংক্রান্ত প্রস্তাব এবং কিছু ভ্যাটের পরিবর্তন কার্যকর হবে আগামী জুলাই থেকে। কেননা আয়কর বর্ষ শুরু হয় জুলাইয়ে, আর শেষ হয় পরের বছরের জুনে।

রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং কর-জিডিপির অনুপাত কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে গতকাল সংসদে উত্থাপিত বাজেটে একগুচ্ছ ভ্যাটের প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা ও এগিয়ে নিতে এসব ভ্যাট প্রস্তাব ভূমিকা রাখবে বলে তিনি জানান। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন খাতে নতুন করে দেয়া হয়েছে অব্যাহতি সুবিধা। আবার আগে থেকে দেয়া এ সুবিধা অনেক ক্ষেত্রে বহালও রাখা হয়েছে। 

নতুন বাজেটে বল পয়েন্ট কলমের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ফলে দাম বাড়বে এ কলমের। সফটওয়্যারের উৎপাদন পর্যায়ে ও কাস্টমাইজেশন সেবার ওপর আরোপ করা হয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট। পলিপ্রোপাইলিন স্টাপল ফাইবারের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তবে এর কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডারের আয়রন বা স্টিলের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূসকের হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। 

দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ওপরও মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে মোবাইল ফোনের। তিন ধরনের দেশী কোম্পানির মুঠোফোনের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে মুঠোফোনের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনে মূসক ২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন সংযোজন করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে দুভাবে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। যেমন কমপক্ষে দুটি যন্ত্রাংশ নিজেরা তৈরি করে মুঠোফোন বানালে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে, যা এখন ৩ শতাংশ হারে দিতে হয়। একই সঙ্গে যারা সব যন্ত্রাংশ আমদানি করে শুধু দেশে সংযোজন করে, সেই প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ওপর ভ্যাট বসবে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে, এখন ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। 

বাজেটে মূসকের হার বৃদ্ধির প্রস্তাবে দাম বাড়বে বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যেরও। এর মধ্যে রয়েছে টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী, হাইজেনিক, টয়লেট সামগ্রী। এসব পণ্যের ওপর মূসকের হার সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে, যা এখন ৫ শতাংশ। দাম বাড়ছে নির্ধারিত বিভিন্ন জিএসএমের কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু ইত্যাদির। এসব পণ্যের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৫ শতাংশ। এছাড়া অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি কিচেন বা অন্যান্য গৃহস্থালি জিনিসপত্র, স্যানিটারিওয়্যার ও যন্ত্রাংশের ওপরও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্য কিনতে হলে দিতে হবে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট, যা বর্তমানে ৫ শতাংশ। সানগ্লাসের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।

দেশীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি কার্যকর থাকছে। একই সঙ্গে এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি ও স্থানীয়ভাবে কেনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট (আগাম করসহ) ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ভ্যাট অব্যাহতির সময় বাড়ানো হয়েছে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেনের উৎপাদন পর্যায়ে। একই সঙ্গে এসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানি ও স্থানীয়ভাবে কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। 

ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, প্রেসার কুকারের উৎপাদন পর্যায়ে মূসকসহ অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত থাকছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে বিভিন্ন পণ্যের রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত থাকছে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।

অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের কর সুবিধার মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বাজেটে। ফলে উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি থাকবে এ পণ্যে। হাতে তৈরি বিস্কুট ও কেকের ভ্যাট সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। মিষ্টির ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে, ফলে কমবে মিষ্টির দাম। কৃত্রিম আঁশের তৈরি কাটা ফেব্রিকস এবং এক মিটারের বেশি দীর্ঘ নয় এমন নষ্ট টুকরায় ভ্যাট পর্যায়ে অব্যাহতির সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আগাম কর অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত রাইস প্লান্টার, ড্রায়ারসহ কিছু পণ্য, আমদানীকৃত সব কনটেইনার, সমুদ্রের লবণ পানি থেকে সুপেয় পানির বিভিন্ন সরঞ্জাম ইত্যাদি।

স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো হয়েছে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত। একই সঙ্গে ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা নিরোধক ওষুধের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বাজেটে দাম বাড়বে সিগারেটের। অর্থমন্ত্রী সিগারেটের নিম্নস্তরের ১০ শলাকার মূল্যস্তর ৪৫ টাকা ও তদূর্ধ্ব এবং সম্পূরক শুল্ক ৫৮ শতাংশ ধার্যের প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া মধ্যম স্তরের ১০ শলাকার মূল্যস্তর ৬৭ টাকা ও তদূর্ধ্ব, উচ্চস্তরের ১০ শলাকার মূল্যস্তর ১১৩ টাকা ও তদূর্ধ্ব, অতি উচ্চস্তরের ১০ শলাকার মূল্যস্তর ১৫০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি। এ তিন মূল্যস্তর এবং এর ওপরে প্রতিটির ওপর সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ আরোপের কথাও জানান মন্ত্রী। 

আগামী বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও হাতে তৈরি ফিল্টার ছাড়া বিড়ির ২৫ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮ টাকা, ১২ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৯ টাকা ও ৮ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ২০ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৯ টাকা ও ১০ শলাকার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৪০ শতাংশ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারণ করে সম্পূরক শুল্ক ৫৫ শতাংশ অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

অনলাইন মার্কেটেপ্লেসে বিক্রীত পণ্যেও ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন মুস্তফা কামাল। বাজেট বক্তৃতায় তিনি জানান, অনলাইনে পণ্য বিক্রি বলতে অনলাইনে খুচরা বিক্রয় বা মার্কেটপ্লেসকে বোঝাবে। তাই এ খাতে এখন থেকে পণ্যসেবায় ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে না। কেননা এসব পণ্য অনলাইনে বিক্রির আগে কোনো উৎপাদনকারী বা সেবা প্রদানকারী কিংবা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মূসক পরিশোধ করেই কেনা হয়। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইন মার্কেটপ্লেস কোম্পানিগুলো পরিষেবা প্রদানের ওপর ভ্যাট প্রদান করে, একই সঙ্গে তারা নিজস্ব পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করলেও ভ্যাট দিয়ে থাকে। 

এদিকে ভ্যাটের নতুন নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তল্লাশি ও জব্দকরণ প্রক্রিয়ার পর দলিলাদি যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পাঁচদিন সময় পাবেন, যা এতদিন ছিল তিনদিন। একই সঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৩০ দিন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন বাজেটে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন