দাম কমবে বাড়বে যেসব পণ্যের

নিজস্ব প্রতিবেদক

করহার বৃদ্ধি বা হ্রাসের কারণে প্রতি বছরই বাজেটে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি ও হ্রাস হয়। সে হিসেবে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটেও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেশকিছু পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক বৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রস্তাব এনেছেন। এতে এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস হতে পারে। 

অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, কলম, আমদানি করা সফটওয়্যার, কাজুবাদাম, নন-ফর্টিফায়েড বাসমতী চাল, প্রক্রিয়াজাত ফল, খেজুর, সিগারেট ও তামাক পণ্য, সিমেন্ট, মোবাইল ফোন, এলপিজি সিলিন্ডার, থালাবাসন এবং বিদেশী লিফটের দাম বাড়তে পারে। এছাড়া ভ্রমণ কর বাড়ানোর প্রস্তাব আসায় বাড়তে পারে বিদেশ যাওয়ার খরচ।

বল পয়েন্ট কলমের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সফটওয়্যারের উৎপাদন পর্যায়ে ও কাস্টমাইজেশন সেবার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সফটওয়্যার আমদানির শুল্ক ২৫ শতাংশ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। খোসা ছাড়ানো কাজুবাদামের করভার ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‌আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলে কাজুবাদাম উৎপাদিত হচ্ছে এবং সেখানে বাদাম প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে।’

নন-ফর্টিফায়েড বাসমতী চাল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। সব ধরনের খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব এসেছে। এর কারণ হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমদানি পর্যায়ে বর্তমানে তাজা খেজুর ও শুকনো খেজুরের ওপর আরোপিত মোট করভারে পার্থক্য রয়েছে। তাই সব ধরনের খেজুরের আমদানি পর্যায়ে সর্বমোট করভার বৃদ্ধিপূর্বক শুল্ক-কর হারের সমতা বিধানের প্রস্তাব করছি।’

সিগারেট ও তামাক পণ্যের শুল্ক বাড়ছে। তরল নিকোটিনের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব এসেছে। ই-সিগারেট ও ভেপোরাইজিং ডিভাইস ও এর যন্ত্রাংশ আমদানিতে ২১২ দশমিক ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। লিফট ও স্কিপ হোস্ট আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া এর কাঁচামালসংক্রান্ত রেয়াতি প্রজ্ঞাপনটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবত রাখার প্রস্তাব করা হয়। এস্কেলেটরের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

আমদানি করা সিমেন্ট ক্লিংকারের প্রতি টনের স্পেসিফিক রেট অব ডিউটি ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য স্পেসিফিক রেট অব ডিউটি ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫০ টাকা করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। স্যান্ডউইচ প্যানেল পণ্যটি মূলধনি যন্ত্রপাতি হিসেবে রেয়াতি সুবিধায় মাত্র ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক পরিশোধ করে আমদানির সুযোগ রয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পণ্যটি কোনো মূলধনি যন্ত্রপাতি নয়। দেশে এটি তৈরি হয়। তাই দেশীয় উৎপাদন উৎসাহিত করতে পণ্যটির আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ের ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া সিলিন্ডার তৈরির দুটি কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) এবং ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‌এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে।’

স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে শূন্য শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ, সংযোজন পর্যায়ে যথাক্রমে ৩ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে প্রজ্ঞাপনের মেয়াদ আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিতকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লিখিত প্রজ্ঞাপনের কিছু শর্ত যৌক্তিকীকরণ ও নতুন শর্ত সংযোজনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্লাস্টিকের তৈরি থালা, বাটি ও অন্যান্য পণ্যের ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অ্যালুমিনিয়ামের থালাবাসন ও রান্নাঘরের সরঞ্জামের ভ্যাট একই হারে বাড়ানো হয়েছে। টিফিন বক্স ও পানির বোতলে ভ্যাট আগের মতো থাকবে। কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল বা পকেট টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়েল/পেপার টাওয়েল/ক্লিনিক্যাল বেড শিটের ভ্যাট হার ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তৈরি চশমার ওপর শুল্ক ২৫ শতাংশ। তবে এর পার্টস আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ। রোদচশমা বা সানগ্লাসের (প্লাস্টিক ও মেটাল ফ্রেমযুক্ত) ভ্যাট ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিসি বা কিলোওয়াট-ভিত্তিক পরিবেশ সারচার্জ আরোপ করেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে একাধিক গাড়ি রাখার ক্ষেত্রে খরচ বাড়বে।

ভ্রমণ কর হিসেবে বর্তমানে স্থল ও জলপথে দেশের বাইরে যেতে ৫০০ টাকা ও নৌপথে ৮০০ টাকা কর বহাল রয়েছে। এটা বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আকাশপথে সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে ১ হাজার ২০০ টাকা কর ছিল। এটি বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করা হয়েছে। আকাশপথে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, হংকং, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও তাইওয়ান যাওয়ার ক্ষেত্রে যাত্রীপ্রতি ৬ হাজার টাকা কর দিতে হবে। বর্তমানে এই করের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ টাকা। এছাড়া দেশগুলোর বাইরে আকাশপথে অন্য কোনো দেশে গেলে ৪ হাজার টাকা কর আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া দেশের ভেতরে আকাশপথে ভ্রমণে ২০০ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৯ ধরনের যাত্রী অব্যাহতি পাচ্ছে ভ্রমণ কর থেকে।

এছাড়া হাতে তৈরি বিস্কুট-কেক, মিষ্টি, অপটিক্যাল ফাইবার, পশুখাদ্য, আমদানীকৃত কনটেইনার, উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমতে পারে।

হাতে তৈরি বিস্কুটের ভ্যাট অব্যাহতি সীমা প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকা এবং কেকের (পার্টিকেক ব্যতীত) ভ্যাট অব্যাহতি সীমা ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। মিষ্টান্ন ভান্ডার সেবার ওপর এখন ভ্যাট রয়েছে ১৫ শতাংশ, যা অর্ধেক কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। পশুখাদ্যের উপকরণ নারকেলের শুষ্ক শাঁসের উচ্ছিষ্ট উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

কৃষিতে ব্যবহৃত রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ড্রায়ার, সকল প্রকার স্পেয়ার মেশিন, পটেটো প্লান্টার, আমদানীকৃত সব ধরনের কনটেইনারের আগাম কর অব্যাহতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অপটিক্যাল ফাইবার কেবল উৎপাদনে আগামী এক বছরের জন্য ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আমদানীকৃত সব ধরনের কনটেইনার, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে সুপেয় পানি উৎপাদনের লক্ষ্যে আমদানীকৃত সোলার পাওয়ার অপারেটেড ওয়াটার ডিস্টিলেশন প্লান্ট এবং নিবন্ধিত এয়ারলাইনসের আমদানীকৃত উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, টার্বো জেট ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে আগাম কর অব্যাহতির প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার ওষুধ উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ক্যান্সার ও ডায়াবেটিসের কিছু ওষুধেও করছাড় দেয়া হয়েছে বাজেটে।

ব্লেন্ডার, জুসার, প্রেসার কুকারের মতো গৃহস্থালি সরঞ্জাম উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আরো দুই বছর (২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) বহাল থাকবে। একই সুবিধা পাবে ওয়াশিং মেশিন এবং মাইক্রোওয়েভ ও ইলেকট্রিক ওভেন উৎপাদনকারী কারখানা। তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার পণ্য উৎপাদনে অব্যাহতি সুবিধা তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার উৎপাদনে এখনকার ৫ শতাংশের অধিক ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ এক বছর বাড়বে। স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতেও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরো এক বছর থাকবে। 

আসন্ন বাজেটে ১৯১টি পণ্যের রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ২৩৪টি পণ্যের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন