পর্যালোচনা

সংঘাতের পথেই কি হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন

নুরিয়েল রুবিনি

জাপানের হিরোশিমায় গত মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় জি৭ শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রত্যাশা করছেন তিনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেনের সঙ্গে এ বিষয়ে বেশকিছু দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও সম্পন্ন হয়। জ্যানেট ইয়েলেন শিগগিরই চীন সফরে যাবেন বলেও জানা গেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও উভয় দেশের মধ্যকার শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটেনি।

সত্যিকার অর্থে, নতুন করে মার্কিন-চীন ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ‘শীতল যুদ্ধের’ সম্ভাবনা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সম্পর্কের বরফ গলার বিষয়টি এখনো সুদূরপরাহত। সম্পর্ক উষ্ণ করার পরিবর্তে জি৭ শীর্ষ সম্মেলন কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘বিস্তৃত নিয়ন্ত্রণ, পরিবেষ্টন এবং দমন’ কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে চীনা উদ্বেগ আরো বেড়েছে। পূর্ববর্তী সম্মেলনের তুলনায় হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনটি গ্রুপের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। কেননা জি৭ নেতারা এর আগের সম্মেলনগুলোয় যেসব কথা বলতেন, তার খুব কম অংশই বাস্তব রূপ পেয়েছে। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ এবং তাদের বন্ধু ও মিত্ররা চীনের বিরুদ্ধে অবস্থানকে আরো স্পষ্ট করেছেন। এ সম্মেলনে জি৭ জোটের নেতারা চীনকে প্রতিহত করার জন্য তাদের শক্তি একত্র করার পরিকল্পনা করছেন।

এছাড়া জি৭ জোটের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জাপান এবারের সম্মেলনে দক্ষিণ বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কেননা উদীয়মান এবং মধ্যম অর্থনীতির দেশগুলোর কাছে পৌঁছানোর মাধ্যমে জি৭ জোটের চাওয়া চীনা উত্থান প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অন্যদেরও আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করা। সম্ভবত এদের অনেকেই এশিয়ায় এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে চীনকে দৃঢ়প্রত্যয়ী একটি কর্তৃত্ববাদী, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় শক্তি হিসেবে চিত্রিত করার সঙ্গে একমত হবেন।

যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক পরিচালনার বিষয়ে ভারত (চলতি বছর জি২০ জোটের প্রেসিডেন্ট) নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। তবে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে জড়িয়ে আছে। যেহেতু দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘ সীমানা রয়েছে, যার বেশির ভাগই বিতর্কিত। সুতরাং ভারত যদি পশ্চিমা দেশগুলোর ঘোষিত মিত্র নাও হয়, তবুও দেশটি নিজেকে একটি স্বাধীন, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে চীনের তুলনায় পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সমুন্নত রাখবে। কেননা চীন এবং চীনের প্রকৃত মিত্র রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের নিজস্ব স্বার্থ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আরো বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এছাড়া ভারত কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগের (কোয়াড) আনুষ্ঠানিক সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া মিলে গঠিত কোয়াড একটি প্রতিরক্ষা জোট। এ জোটের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য চীনের উত্থান প্রতিরোধ করা। জাপান ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এছাড়া চীনের সঙ্গে উভয় দেশেরই বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের একটি সাধারণ ইতিহাস রয়েছে।

জাপান এ শীর্ষ সম্মেলনে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজালি আসুমানি ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য কিছুটা স্পষ্ট। কেননা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এরই মধ্যে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ বিশ্বের অন্য এক শক্তিধর দেশ হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে ব্রাজিল। বার্তাটি ছিল স্পষ্ট, মস্কো-বেইজিংয়ের দহরম মহরম সম্পর্ক অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের বোঝাপড়ায় প্রভাব রাখছে। 

কিন্তু সম্মেলনে জি৭ নেতারা আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। জি৭ জোটের চূড়ান্ত বিবৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কীভাবে আগামী বছরগুলোয় চীনকে মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এ বিবৃতিতে চীনের ‘অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ নীতির নিন্দা করা হয়েছে। পাশাপাশি এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে চীনা প্রচেষ্টাকে রুখে দিতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারত্বমূলক পদক্ষেপের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সম্প্রসারণবাদের সমালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া তাইওয়ানের ওপর আক্রমণ না করার বিষয়ে চীনের প্রতি স্পষ্ট সতর্কবার্তা জুড়ে দেয়া হয়েছে।

চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ঝুঁকিমুক্ত করতে পশ্চিমা নেতারা এমন একটি ভাষায় কথা বলেছেন, যা বিচ্ছিন্নতাবাদের তুলনায় কিছুটা কম আক্রমণাত্মক। কিন্তু এটি কূটনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলো নিয়ন্ত্রণমূলক প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলোকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে সংযুক্ত রাখার নীতি অনুসরণ করবে। এসব দেশকে চীনের প্রভাববলয় থেকে দূরে রাখতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে জি৭ জোটের এমন বিবৃতির বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে চীন। কোয়াডের প্রসারণের পাশাপাশি হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনটির চীনাবিরোধী বিবৃতি এমন একসময়ে এসেছে, যখন ন্যাটো এশিয়ায় তাদের নিজস্ব কার্যক্রম শুরু করেছে। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত এইউকেইউএস জোট প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

এদিকে পশ্চিমা দেশ ও চীনের মধ্যে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ ক্রমে তীব্রতর হচ্ছে। জাপান চীনে চিপ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত বিধিনিষেধের তুলনায় যা কম কঠোর নয়। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর চীনা তৎপরতা প্রতিরোধে চীনকে চাপ দিচ্ছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিপ নির্মাতা কোম্পানি মাইক্রনের চিপ ক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে চীন।

আরেক মার্কিন চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া দ্রুত একটি করপোরেট সুপার পাওয়ার হয়ে উঠছে। টেক জায়ান্টটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির জন্য চিপ নির্মাণ করে থাকে। বর্তমানে এআই খাতের উন্নত চিপের চাহিদা বাড়ার কারণে দ্রুত বিস্তৃতি হচ্ছে এনভিডিয়ার। তবে চীনের বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে সম্ভবত এ প্রতিষ্ঠানও নতুন বিধিনিষেধের মুখোমুখি হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা এআইয়ের শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে চীনকে অন্তত একটি প্রজন্ম পিছিয়ে রাখতে চায়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ চিপ উৎপাদন বাড়াতে গত বছর ‘চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে ব্যাপক প্রণোদনা সুবিধা চালু করে।

পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রযুক্তিগত ব্যবধান দূর করার ক্ষেত্রে বর্তমানে চাপের মুখে রয়েছে চীন। এখন ঝুঁকি হচ্ছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে মূল্যবান ধাতু উৎপাদন এবং পরিশোধনের ক্ষেত্রে চীন তার প্রভাবশালী ভূমিকা ব্যবহার করবে। এসব ধাতু পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দেশটি ২০১৯ সাল থেকে এরই মধ্যে প্রায় ৭০০ শতাংশ বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি (ইভি) রফতানি বাড়িয়েছে। এছাড়া মার্কিন কোম্পানি বোয়িং ও ইউরোপীয় নির্মাতা এয়ারবাসের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উড়োজাহাজ নির্মাণ শুরু করেছে।

সুতরাং জি৭ জোট হয়তো ‘শীতল যুদ্ধ’কে আরো তীব্রতর না করে চীনকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। কিন্তু বেইজিংয়ের ধারণা অনুযায়ী, পশ্চিমা নেতারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। এখন আগের চেয়েও স্পষ্ট হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহত্তর পশ্চিমা দেশগুলো চীনের উত্থান রোধে অঙ্গীকারবদ্ধ।

অবশ্যই চীনের এটা ভুলে গেলে চলবে না, বর্তমানের এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরিতে মার্কিন নীতির পাশাপাশি বেইজিংয়ের নিজস্ব আগ্রাসী নীতিও কমবেশি দায়ী। সম্প্রতি শততম জন্মদিন উপলক্ষে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এই বলে সতর্ক করেন যে যদি দুই দেশের মধ্যে নতুন কৌশলগত বোঝাপড়া তৈরি না হয়, তবে তারা সংঘাতের পথেই থাকবে। সম্পর্ক যত শীতল হবে, তত গভীর হবে বৈরিতা, তৈরি হবে ভয়ংকর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

নুরিয়েল রুবিনি: নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। অ্যাটলাস ক্যাপিটাল টিমের প্রধান অর্থনীতিবিদ, রুবিনি ম্যাক্রো অ্যাসোসিয়েটসের সিইও, দ্য বুমবস্ট ডটকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ‘মেগাথ্রেটস: টেন ডেঞ্জারাস ট্রেন্ডস দ্যাট ইমপেরিল আওয়ার ফিউচার অ্যান্ড হাউ টু সারভাইভ দেম’ গ্রন্থের লেখক।

ভাষান্তর: আল আমিন হাওলাদার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন