ডেঙ্গু সংক্রমণ এবার পাঁচ গুণ বেড়েছে

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা যেন থামছেই না। প্রতি বছর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। গত বছরের তুলনায় এ সময়ে পাঁচ গুণ বেশি সংক্রমণ হয়েছে। চলতি শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর আবির্ভাব শুরু হওয়ার পর রোগটির তীব্রতা বাড়ছে, যার রেশ থেকে রেহাই পাচ্ছে না দেশের মানুষ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। দীর্ঘ দুই যুগ হতে চললেও এ রোগের সংক্রমণ কমানো যাচ্ছে না।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত ৩০ মে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন দেশে গত বছরের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। এজন্য সবার বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচার পালন করার প্রতি মন্ত্রী জোর দিয়েছেন। এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন মহলকে যুক্ত করার বিষয়টিও তিনি অবহিত করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মূলত সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু মোকাবেলায় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতার প্রতিও জোর দেয়া হচ্ছে। বাসার আশপাশের আঙিনা পরিষ্কার রাখা, থাকার ঘরে অ্যারোসল স্প্রে করা, বসতস্থলের আশপাশে জঙ্গল থাকলে সেখানেও স্প্রে করা এবং কোথাও পানি বা যদি অন্য কিছু জমে থাকে, সেগুলো সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করা হয়েছে। এখন মোটা দাগে যে প্রশ্নটি ওঠে, সেটি হলো ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণের পরও কেন এর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? এরপর ২০২১ সালেও ডেঙ্গু ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এবারো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বেগের ছায়া দেখা দিয়েছে।

সাধারণত জুনের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলেও এ বছর মে মাস থেকেই রোগটির প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জুলাইয়ের দিকে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এ বছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এছাড়া মে মাসে বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের বরাতে জানা যায়, মূলত দুটি কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। তা হলো জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়ণ। এদিকে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এখন অনেকেই ঢাকার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে পারছে। বিগত বছরে হাসপাতালে চিকিৎসা না নেয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে রোগটির প্রকৃত চিত্র ফুটে না ওঠার বিষয়টি উঠে আসে। 

ডেঙ্গু প্রথমে ঢাকা শহরে শনাক্ত হয়, প্রথম দিকে একে ‘ঢাকা ফিভার’ বলা হতো। বর্তমানেও রোগটির প্রকোপ ঢাকাতেই বেশি দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর পর কক্সবাজারে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। নিরাপত্তার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা কঠিন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানুষের ঘনত্ব বেশি এবং পানি সংকটের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে পানি পাত্রে জমিয়ে রাখা হয়, আর এ পানিতেই মশা জন্ম নেয়। তবে ভাষাগত সমস্যা ও ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশজনিত সমস্যার কারণে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণের খেসারত দিতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগের বিস্তারের মাধ্যমে। বলা যায়, ডেঙ্গুর ‘হাব’ বা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ঢাকা। এজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে সেটি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এক্ষেত্রে বাসাবাড়িতে যেন ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার লার্ভা না জন্মায় সেজন্য নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা বেশ সফল হয়েছে। ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশ যখন ডেঙ্গুর প্রকোপে ভুগছে, তখন কলকাতা কয়েক বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।

কলকাতা সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, তারা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি পরিচালনা করে যেন কোথাও পানি না জমে থাকে। এর জন্য বহু কর্মী যেমন রয়েছেন, তেমনি এ কাজে আকাশে ড্রোনও ওড়ানো হয়। অন্যদিকে শহরের প্রতিটি হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, কী ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এভাবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এজন্য যথেষ্ট প্রচারণা চালায়। কোথাও এডিস মশার লার্ভা পেলে জরিমানা আদায় করে সে জায়গা পরিষ্কার করা হয়। তবে কলকাতা একেবারেই যে ডেঙ্গু নির্মূল করতে পেরেছে, সেটি না হলেও অন্তত নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে তা বলা যায়। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যায়, এজন্য কলকাতা বাংলাদেশকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার আগ্রহও প্রকাশ করেছে।

ভৌগোলিক নৈকট্যের দিক থেকে এ রকম সফল উদাহরণ থাকার পরও বাংলাদেশের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল না হওয়াটা দুঃখজনক। সেই সঙ্গে ক্রমেই এ রোগের বিস্তার হওয়াটা অপ্রত্যাশিত। আমরা এর অবসান দেখতে চাই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই, এজন্য হাসপাতালগুলোও তৈরি রাখা দরকার। প্রয়োজন হলে ডেঙ্গুকে মহামারী ঘোষণা করে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত, যে দাবি ২০১৯ সালেও উত্থাপন করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে সেবার মান বৃদ্ধি এবং বেসরকারি হাসপাতালে যেন নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত না নেয়া হয় সেটি তদারকি করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এজন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মশা দমনে প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর বাজার যেন অস্থিতিশীল না হয়, সেটিও মনিটরিং করা প্রয়োজন। সর্বোপরি ডেঙ্গু দমনে কোথাও যেন ঘাটতি না থাকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর। আমরা প্রত্যাশা করব, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে সরকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন