ভারত থেকে বিদ্যুচ্চালিত ১০০ বাস কিনছে বিআরটিসি

আড়াই কোটি টাকার বাস সাড়ে তিন কোটিতে কেনার প্রস্তাব

ইয়াহইয়া নকিব

ভারত থেকে ১০০টি বিদ্যুচ্চালিত দ্বিতল বাস কেনার উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। এজন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে প্রতি ইউনিট বাসের দাম ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় দেশটির শীর্ষস্থানীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অশোক লেল্যান্ডের সাবসিডিয়ারি ‘সুইচ মোবিলিটি কোম্পানি’ থেকে বাসগুলো কেনা হবে। 

বিআরটিসির প্রস্তাবে উল্লিখিত দ্বিতল বাসগুলোর বৈশিষ্ট্য সুইচ মোবিলিটির ‘‌সুইচ ইআইভি ২২’ মডেলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। গত বছরই ভারতের বাজারে মডেলটি উন্মুক্ত করা হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যানুযায়ী, ‘‌সুইচ ইআইভি ২২’ মডেলের প্রতি ইউনিট দ্বিতল বাসের দাম প্রায় ২ কোটি রুপির কাছাকাছি। গতকাল ভারতীয় প্রতি রুপির বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ১ টাকা ৩০ পয়সা। সে হিসাবে প্রতি ইউনিট বাসের দাম পড়ে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার আশপাশে।

প্রতি ইউনিট বাস কেনার জন্য বিআরটিসি যে দাম প্রস্তাব করেছে, তাতে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করছে ‘বিআরটিসির জন্য ১০০টি দ্বিতল বৈদ্যুতিক বাস সংগ্রহ’ প্রকল্পের ‘‌প্রকল্প যাচাই কমিটি’। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রস্তাবিত বাসগুলোর জন্য কোনো রেট শিডিউল নেই। এমন প্রেক্ষাপটে কিসের ভিত্তিতে বাসগুলোর দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, তা জানাতে হবে। 

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়েছে, ভারতের অশোক লেল্যান্ডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সুইচ মোবিলিটি থেকে বাসগুলো কেনা হবে। ১০ বছর আয়ুষ্কালের এসব বাস দিনে ২০০ কিলোমিটার যাতায়াত করবে। প্রতি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে বিদ্যুৎ খরচ হবে ২ দশমিক ৩৫ কিলোওয়াট। ব্যাটারির ধারণক্ষমতা ৩০০ কিলোওয়াট। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি বাসে আসন থাকবে ৬৫টি।

‘‌সুইচ মোবিলিটি’র ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে দ্বিতল শ্রেণীর দুটি মডেল বাজারজাত করছে কোম্পানিটি। এর একটি হলো ‘সুইচ মেট্রোডেকার’, আরেকটি ‘‌সুইচ ইআইভি ২২’। ডিপিপিতে প্রস্তাবিত বাসগুলোর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ‘‌সুইচ ইআইভি ২২’ মডেলটি মিলে যায়, যার দাম ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২ কোটি রুপি।

গত ১০ এপ্রিল প্রকল্পটির ওপর অনুষ্ঠিত ‘‌যাচাই কমিটি’র সভায় প্রস্তাবিত বাসগুলোর দাম নিয়ে অস্পষ্টতার কথা বলা হয়। সভায় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বাসের দাম নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট করতে বলা হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী দাম নির্ধারণের কথা বলেছিল বিআরটিসি। মন্ত্রণালয় ঘুরে প্রকল্পটি এখন রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। কমিশন থেকে বাসের দামের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাসগুলোর দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে এ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য দিতে চাননি বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‌সব তথ্য তো আমার মাথায় থাকে না। আপনি আমার অফিসে এসে বিস্তারিত জেনে যান।’ পরে বিআরটিসির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। গতকাল পুনরায় ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

বিআরটিসির প্রস্তাবিত বাসের দাম এবং ভারতের সুইচ মোবিলিটি কোম্পানির সমমানের বাসের বিক্রয়মূল্য সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একাধিক অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বণিক বার্তা। তারা বলেন, ‘‌সুইচ ইআইভি ২২’ চালুর সময় ভারতে যে বাজারমূল্য ছিল, বিআরটিসি সমমানের বাস কেনার জন্য তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি মূল্য প্রস্তাব করেছে। যদি একই টেকনোলজির বাস হয়, তাহলে দামের এ তারতম্যের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে বাসগুলোর ‘‌ক্যাপাবিলিটি রেঞ্জের’ ভিন্নতা, বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য, ব্যাটারির সক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের কারণে দামে কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। তবে দেড় গুণ বেশি দাম হওয়া অস্বাভাবিক। 

বিআরটিসির জন্য প্রস্তাবিত বাসগুলোর দামের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো উইংয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌অনেক সময় ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রকল্প প্রস্তাবে দাম কম-বেশি হয়। দাম নির্ধারণের বিষয়ে বিআরটিসির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।’

‘বিআরটিসির জন্য ১০০টি দ্বিতল বৈদ্যুতিক বাস সংগ্রহ’ প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৯৬ কোটি টাকা ঋণসহায়তা দেবে ভারত। বাকি ২৫৬ কোটি টাকা জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার।

প্রকল্পের জন্য বাস কেনা বাবদ মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে আটটি চার্জিং স্টেশন তৈরি করতে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে চারটি চার্জিং স্টেশন তৈরি করা হবে রাজধানী ঢাকায়। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে হবে। এর বাইরে খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার জন্য ৬৮ কোটি, ৪৬০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ২৭ কোটি, স্থানীয় প্রশিক্ষণের জন্য পাঁচ কোটি ও জেনারেটর কেনার জন্য ২৬ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে ডিপিপিতে।

ডিপিপিতে সরকারি অর্থায়নে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন চার্জিং স্টেশনের সংস্থান রাখা হলেও ভবিষ্যতে খাতটি বেসরকারিভাবে ছেড়ে দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ব্যবসা করা সরকারের কাজ না। সরকার নীতি তৈরি করে দেবে। সিএনজি স্টেশনের মতো বৈদ্যুতিক যানবাহন চার্জিং স্টেশন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে মানুষ সহজেই সেবা পাবে।’ বিআরটিসির কাছে এ সেবার দায়িত্ব ছেড়ে দিলে সরকারি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে এ সময় মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকার মতো যানজটপূর্ণ শহরে বিদ্যুচ্চালিত বাস চালানোর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যানজটের কারণে একদিকে যেমন বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ হবে, তেমনি মাঝপথে চার্জ শেষ হয়ে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন