২৫তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী-২০২৩

চিত্রে-শিল্পে বিন্যাস হারানো পৃথিবীর প্রতিধ্বনি

রুহিনা ফেরদৌস

শিল্পী এসএম সুলতানের আঁকা চিত্রকর্ম ছবি: সালাহউদ্দিন পলাশ

বিক্ষিপ্ত বর্তমানে দাঁড়িয়ে খুব বেশি দূর দেখা যায় না। বিন্যাস হারানো পারিপার্শ্বিকতা, ক্ষয়িষ্ণু আত্মবোধ-অস্তিত্ব, ছন্দবিমুখ বাস্তবতার টানাপড়েনের মুখোমুখি মানুষের দূর দেখার সময় কোথায়! সময় কোথায় পৃথিবীর অসুখ নিয়ে ভাবনার! অথচ পৃথিবীর প্রতিধ্বনি শুনতে কান পাততে হয় মাটির বুকে, মিশতে হয় জলের সঙ্গে, বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে হাঁটতে হয় কিছুদূর। কিন্তু সময় কোথায় এত স্পর্শকাতরতার! বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ২৫তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ঘুরেফিরে সজীব হয়ে উঠেছে এসব স্পর্শকাতরতার গল্প। 

কেননা সৃষ্টিশীল মানুষেরা বরাবরই ভীষণ স্পর্শকাতরতায় ভর করে এঁকে চলেন পৃথিবীর, মানুষের, সময়ের কথা। এসএম সুলতান যেমন এঁকেছেন একান্ত বাংলার, পলি-মাটির, মানুষের, ধান-কুটো, বৃক্ষ রোপণের ছবি। ক্যানভাসে তেলরঙে ১৯৭৬ সালে সুলতান আঁকেন ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’। তার পেইন্টিং ও জলরঙে আঁকা ২৬টি চিত্রকর্মসহ ব্যবহার করা রঙ-তুলি-কলম, ছবি আঁকার সারঞ্জাম, জামা, জুতাসহ বিভিন্ন উপকরণের দেখা মেলে চিত্রশালার ৫ নম্বর গ্যালারিতে। 

এবারের আয়োজনটি খানিকটা বিশেষ। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীটি যেমন পঁচিশের মাইলফলক ছুঁয়েছে, তেমনি এ বছর শিল্পী সুলতানের জন্মশতবার্ষিকী। সুলতানকে নিয়ে ‘শতবর্ষে সুলতান’-এর কিউরেশন করেছেন শিল্পী ও কিউরেটর শাওন আকন্দ। 

কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সঙ্গে সুলতানের সম্পর্ক পুরনো। সুলতানের ছবি ঢাকায় প্রথম প্রদর্শিত হয় ১৯৭৫ সালে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। এরপর ১৯৭৬ সালে ঢাকায় তার কাজের একক প্রদর্শনীর আয়োজনও করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এর পর থেকে আমরা মূলত সুলতানকে চিনতে শুরু করি।’ 

আমাদের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সুলতান প্রাসঙ্গিক। নদীমাতৃক বাংলার কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের বেঁচে থাকার লড়াই, বিদ্রোহ, ভালোবাসা, স্বপ্ন, সংগ্রাম আর আনন্দ-বেদনার কাব্য সুলতানের শিল্পকর্ম যাপিত জীবনের কেন্দ্রে বিদ্যমান। অথচ সুলতানকে নিয়ে বড় পরিসরে তেমন কোনো আয়োজন নেই। শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব সংগ্রহে থাকা চিত্রকর্মগুলো নিয়েই হচ্ছে শতবর্ষে সুলতান। শাওন আকন্দ প্রস্তুতি পর্বে হাতে সময়ও খুব বেশি পাননি। ‘সুলতানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় পর্যায় থেকে আরো বড় আয়োজন হতে পারত। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। সান্ত্বনা এটুকুই যে একদম কিছু না হওয়ার চেয়ে এ প্রদর্শনী হচ্ছে, এখান থেকেই সুলতানকে নিয়ে আলোচনাটা বরং শুরু হোক’—বলেন শাওন। 

সময়স্বল্পতার কথা জানালেন কিউরেটর সুমন ওয়াহিদও। ১০ জন শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন ‘আত্মানুসন্ধান’। এ প্রকল্পে শিল্পীদের রেখাচিত্র, চিত্রকর্ম, ছাপচিত্র, ডিজিটাল ইমেজ প্রভৃতির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে নিজ অস্তিত্বের বিবিধ বয়ান। অনেক ক্ষেত্রেই এসব উপস্থাপনা হয়ে উঠেছে আমাদের সমকালীন নানা পরিপ্রেক্ষিতেরই আত্মানুসন্ধান। যেমন ‘শিল্প, রাজনীতি ও আমি’ শিরোনামের কাজে শিল্পী সঞ্জয় চক্রবর্তী নিজ প্রতিকৃতির মাধ্যমে চারপাশের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ, পীড়নকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি সিরিজটি শুরু করি ২০০৯ সালের দিকে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও শিল্পের মধ্যে আমার অস্তিত্ব ও আমার অবস্থানকে খুঁজতে গিয়েই মূলত সিরিজটির জন্ম। কাজগুলো আকারে ছোট। কারণ এটা অনেকটা ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখার মতো। বৌদ্ধ বিহার কিংবা মন্দিরের টেরাকোটায় যেমন দেখা যায় একটা ফ্রেমের মধ্যে একটা ইমেজ, মূলত এটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সিরিজটা অনেক বড়, প্রদর্শনীতে ১০টা কাজ দেখানো হয়েছে।’ এ প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী অন্য শিল্পীরা হলেন শেখ আফজাল হোসেন, সুশান্ত কুমার অধিকারী, মো. ফখরুল ইসলাম মজুমদার, আরাফাত করিম, মিশকাতুল আবীর, শেখ ফাইজুর রহমান, নূর মুনজেরীন রিমঝিম, প্রসূন হালদার ও আহসানা নাসরীন হক অঙ্গনা। 

আত্মানুসন্ধান সম্পর্কে কিউরেটর সুমন ওয়াহিদ বলেন, ‘ইতিহাসে দর্শনচর্চার একটি মূল প্রশ্ন “‍আমি কে?’’। অন্যান্য জ্ঞানকাণ্ডেও এ প্রশ্ন অনুরনিত হয় বারবার। কেউ নিজেকে জানার মাধ্যমে জগৎকে চিনতে চায়; আবার কেউবা জগৎ অনুসন্ধানের মাধ্যমে আত্মানুসন্ধানে ব্রতী হয়। শিল্পীদের মধ্যেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় শিল্পীদের আত্মপ্রতিকৃতি অঙ্কন একটি বিশেষ জনপ্রিয় ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজেও নিজ অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটেছে বহুমুখীভাবে। কেউ সরাসরি আত্মপ্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন, কেউবা আত্মপ্রতিকৃতির অন্তরালে বৃহৎ কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গকে অন্বেষণ করেছেন। কোনো শিল্পী নিজ পরিমণ্ডলে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন ভিন্ন কোনো রূপে।’ 

আত্মানুসন্ধানের বিপরীত দেয়ালে রয়েছে প্রকল্প ‘পানির দামে কেনা’। দলগত কাজটি কিউরেট করেছেন অভিজিৎ চৌধুরী। তিনি তার কিউরেটরিয়াল নোটে লিখেছেন, ‘পানি সংকটের কারণ হিসেবে মোটা দাগে যে ফ্যাক্টরগুলো দায়ী তা হলো পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানিদূষণ ও অপচয়। বিশুদ্ধ পানির সংকেত এ পানির গ্লাস। সেটারই যেন চিত্রিত রূপ হচ্ছে আমার এই চিত্রকর্ম।’ থ্রি ডাইমেনশনাল স্পেসের প্রতিফলন হিসেবে প্লাস্টিকের গ্লাস জয়েন্ট দিয়ে স্থাপনাশিল্পটি সাজানো হয়েছে। কাজটি দেখতে গিয়ে খানিকটা দ্বিধায় পড়তে হয়। এত শত প্লাস্টিকের ব্যবহার ‘পানির দামে কেনা’-কে কতটা পরিবেশবান্ধব কাজ হিসেবে দর্শকের কাছে তুলে ধরেছে তা প্রশ্ন। তাছাড়া কয়েকজন শিল্পীর কাজের কিউরেশন না হয়ে অনেকটা একক প্রকল্পের মতো করেই উপস্থাপিত হয়েছে, যা কিউরেশন ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না। 

এ অবস্থায় খানিকটা স্বস্তি হয়ে আসে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর করা আর্থ’স ইকো বা পৃথিবীর প্রতিধ্বনি কাজটি। কারু তিতাস, প্রমথেশ দাস পুলক, মাহমুদা সিদ্দিকাসহ সাতজন শিল্পীর কাজটি কিউরেট করেছেন হারুন আর রশিদ। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপনা, ভিডিও আর্টের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তুলে ধরেছেন নিজস্ব অবস্থান। 

‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ২০২৩’ গ্রান্ড পুরস্কারসহ এবার প্রত্যেকটি মাধ্যমে একটি করে মোট ১১টি বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়া হয়। স্থাপনা শিল্পে ‘রূপান্তর-২’ নামের কাজের জন্য গ্রান্ড পুরস্কার পেয়েছেন জেসমিন আকতার। কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিজীবনে নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, সংকট, আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনার অস্তিত্ব অনিবার্য সত্য। ব্যক্তির এ সত্যগুলো অবদমন করে তার সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের মানদণ্ড। এমন পরিস্থিতিতে আমার মন তার অবদমিত অনুভূতির প্রকাশ ঘটায় স্বপ্নে, কল্পনায়, অবচেতনে বা স্বতঃস্ফূর্ততায়। আমি অবচেতনকে খুঁজেছি স্বপ্নের অভ্যন্তরে। স্বপ্নকে নিজস্ব বিন্যাসে প্রতিফলিত করেছি।’

ভাস্কর্যে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন সৈয়দ তারেক রহমান। তার কাজের নাম ‘অস্তিত্ব-৩’। ভিড়ের রাস্তায় ছড়ানো বৈদ্যুতিক ও টেলিফোন তারের জগাখিচুড়ি। ক্রমশ ছুটে চলা আর যান্ত্রিক জীবনের দমবন্ধতার মধ্যে অস্তিত্বের অনুসন্ধান করছেন শিল্পী। পিতলের কাস্টিং ও কনস্ট্রাকশনের কম্বিনেশনে তৈরি ভাস্কর্যটি মূলত যান্ত্রিক বাস্তবতার প্রতিধ্বনি। কাজ নিয়ে সৈয়দ তারেক বলেন, ‘মাস্টার্সের সময় থেকেই শহরের রোজকার জীবনযাপন নিয়ে ভাবনার শুরু। মানুষ অর্গানিক সত্তা। অথচ এ শহরের মানুষ প্রকৃতির বাইরে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এভাবে ক্রমেই অস্তিত্বের বিপন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছি আমরা। কাজের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেছি। অস্তিত্ব-৩ আমার ধারাবাহিক কাজের অংশ।’ 

শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ক্যাটাগরিতে চিত্রকলায় সেরা হয়েছেন জয়তু চাকমা, স্থাপনা শিল্পে সজীব কুমার দে, ছাপচিত্রে নূসরাত জাহান, গ্রাফিক ডিজাইনে জিহাদ রাব্বি, কারুকলায় ফারহানা ফেরদৌসী, মৃৎশিল্পে অসীম হালদার ও আলোকচিত্রে মো. আসাদুর জামান আসলাম মোল্লা। 

উল্লিখিত পুরস্কার ছাড়াও পাঁচটি সম্মানসূচক পুরস্কার ও স্পন্সরশিপ পুরস্কার দেয়া হয়। সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন আব্দুস সাত্তার, নাঈমা আখতার, রাউফুন নাহার রিতু, মো. তরিকুল ইসলাম ও আশরাফুল হাসান। 

‘একটি পাত্রের উপাখ্যান’-এর জন্য শিল্পী ফারেহা জেবা পেয়েছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সম্মাননা পুরস্কার। বেশকিছু দিন ধরে ‘জার’ বা পাত্র নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পাটের সুতলি দিয়ে তৈরি ইনস্টলেশনধর্মী কাজটি তুলে ধরে নারীত্ব, মাতৃত্বের গল্প। শিল্পী ফারেহা জেবা বলেন, ‘একজন নারী তার জীবন পরিবারের জন্য দিয়ে দেয়। আদিম সমাজে মাতৃত্ব পূজা হতো। সে সময় একজন নারীকে যে সম্মান দেয়া হতো আজ তা অনেকাংশে লুপ্ত। পাত্রে আমরা যেমন শস্য, খাবার কিংবা বিভিন্ন জিনিস রাখি, নারীর জরায়ু তেমন সন্তান ধারণ করে। ইচ্ছে করেই আমি পাত্রটিকে ভেঙে দিয়েছি। ভেতরে বিভিন্ন ফিগার ড্রইং করেছি। দর্শক যেন ইনস্টলেশনটির মধ্যে দাঁড়িয়ে পাত্রের ভেতরের আধার অনুভব করতে পারে।’ 

২৫তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০২৩ নীতিমালা অনুযায়ী ২১ বছরের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশের ১ হাজার ১৩৮ জন শিল্পীর ২ হাজার ৯১৪টি শিল্পকর্ম জমা পড়ে। ছয় সদস্যের নির্বাচকমণ্ডলী বিভিন্ন বিভাগ থেকে ২৬১ জন শিল্পীর ৩০১টি শিল্পকর্ম নির্বাচন করেন। প্রদর্শনীতে ৯৬টি চিত্রকলা, ৩৯টি ছাপচিত্র, ২২টি আলোকচিত্র, ৬০টি ভাস্কর্য, চারটি প্রাচ্যকলা, ছয়টি মৃৎশিল্প, ১০টি কারুশিল্প, সাতটি গ্রাফিক ডিজাইন, ৩৮টি স্থাপনা শিল্প, ১১টি নিউ মিডিয়া আর্ট ও তিনটি পারফরম্যান্স আর্ট রয়েছে। পারফরম্যান্স আর্টে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ পারফরম্যান্স আর্ট গ্রুপের ‘শিল্পীত বাংলাদেশ’। কাজটির মাধ্যমে আর্ট গ্রুপের সদস্যরা বিলুপ্ত হতে থাকা মানবতাকে ফিরিয়ে আনার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন। যদিও গ্যালারিতে বিভিন্ন শিল্পকর্মের ভিড়ে আলোকচিত্রশিল্পীদের কাজগুলো তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাছাড়া কোন কাজগুলোকে কেন পুরস্কৃত করা হচ্ছে তা নিয়েও কোনো বিবৃতি চোখে পড়েনি। রোববার শুরু হওয়া ২৫তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী চলবে আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন