‘আমাদের প্রচেষ্টা বৈশ্বিক প্লাটফর্মে বাংলাদেশকে তুলে ধরা’

উদ্যোক্তা ও শিল্প সংগ্রাহক দুর্জয় রহমান। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন শিল্পীর শিল্পকর্ম সংগ্রহ করছেন। শিল্পী ও আর্ট প্র্যাকটিশনারদের সহযোগিতা করতে প্রতিষ্ঠা করেছেন দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (ডিবিএফ)। তিনি বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল সোর্সিং ব্যবসা উইনার ক্রিয়েশনস লিমিটেডের পরিচালক। ‘নভেরা’র সঙ্গে শিল্প সংগ্রহ, চিত্রকলার বাজার ও চাহিদাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন তিনি

শিল্প সংগ্রাহক হবেন—কেন মনে হলো?

১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে যখন শুরু করেছি তখন এমন পরিকল্পনা ছিল না। একটা সময় পত্রিকায় প্রকাশিত রফিকুন নবীর কার্টুন সংগ্রহ করতাম। প্রয়াত সমরজিৎ রায় চৌধুরী আমাকে তার বিখ্যাত একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন, যা আমাকে ক্রমেই শিল্প সংগ্রহে উৎসাহী করে তোলে। 

শিল্প সংগ্রহ একটা জার্নি। কারো হঠাৎ মনে হলো সে একজন শিল্প সংগ্রাহক হবেবিষয়টি এমন নয়। আগ্রহ নিয়ে মনোনিবেশ করে শিল্প সংগ্রহ করতে হয়। 

প্রথম সংগ্রহ কী ছিল?

একটা চ্যারিটি প্রদর্শনী থেকে শিল্পী রফিকুন নবীর ‘ওপেন ডোর’ (১৯৮৯) সংগ্রহ করেছিলাম। উডকাট টেকনিক ব্যবহার করে করা শিল্পকর্মটি তার দুর্দান্ত একটি কাজ। 

আপনার সংগ্রহের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো— 

শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের ‘দাগ-তামাশা’। কাজটি ভীষণ মজার। ঢাকা আর্ট সেন্টারে প্রদর্শনীটা হয় ২০১৩ সালে। তখন শিশিরদাকে আমার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলাম। কাজটি আমি ২০২১ সালে সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। এছাড়া দিলারা বেগম জলি, তৈয়বা বেগম লিপিসহ সমসাময়িক শিল্পীদের কাজ রয়েছে আমার সংগ্রহে। দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে রয়েছে মোহাম্মদ কিবরিয়া, সফিউদ্দীন আহমেদ, রশিদ চৌধুরী, কামরুল হাসান, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, নভেরা আহমেদ, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, নিসার হোসেন, ঢালি আল মামুন, ফিরোজ মাহমুদ, মুনেম ওয়াসিফসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পীর কাজ। দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও আমাদের সংগ্রহ দুটো দুই জিনিস। কিছু সংগ্রহ আমার ব্যক্তিগত, কিছু ফাউন্ডেশনের।

দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন (ডিবিএফ) কেন করলেন?

আমাদের একটা প্লাটফর্ম থাকা প্রয়োজন, যেখানে বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পীরা পরস্পরের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করবেন, দেশ-বিদেশে যোগাযোগ তৈরি হবে-এ ধারণা থেকে ২০১৮ সালে দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত। ‘দুর্জয় বাংলাদেশ’ নামটা দেয়া ‘অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ চিন্তা থেকে। ডিবিএফ শিল্পী ও আর্ট প্র্যাকটিশনারদের কাজকে প্রমোট করে। এর লক্ষ্য গ্লোবাল সাউথসহ বৈশ্বিক প্লাটফর্মে শিল্প ও শিল্পীদের সংযোগ ঘটানো। 

প্রতিষ্ঠার পর ডিবিএফ কী ধরনের কাজ করেছে?

২০১৯ সালে ‘মাঝি’ নামে একটা রেসিডেন্সি করা হয়। ভেনিস বিয়েনালে মাঝি রেসিডেন্সিতে বাংলাদেশ থেকে ছয়জন ও ভেনিস থেকে পাঁচজন শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। মাঝি মানে নৌকার চালক, পথপ্রদর্শক। এ রেসিডেন্সিটা এক স্থান থেকে অন্যত্র যাচ্ছে। ভেনিসের পর ২০২০ সালে বার্লিনে ও ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডসে গেছে। এছাড়া ডিবিএফ থেকে দুটো কাজ লোন নিয়ে গেছে সারজা আর্ট বিয়েনাল। এরপর জানুয়ারিতে তা কিরণ নাদাল মিউজিয়ামে দেখানো হয়। এ জার্নিগুলো দারুণ। 

শিল্পী নির্বাচনের কাজগুলো আপনারা কীভাবে করেন? 

এগুলো মূলত কিউরেটর বেজ প্রজেক্ট। আমরা শিল্পী নির্বাচনসহ অন্য কাজগুলোর জন্য একজন কিউরেটরের ওপর দায়িত্ব দিই। গোটা ব্যাপারটাই তার ওপর নির্ভর করে। 

ডিবিএফ বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় কী ধরনের অবদান রাখতে আগ্রহী? 

আমাদের চিত্রকলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অথচ সে তুলনায় আমরা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। ঔপনিবেশিকতা, এরপর দীর্ঘদিন পাকিস্তানের অধীনে, সবকিছু মিলিয়ে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে আছি। দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এখানে কাজ করতে চায়। শুধু আমরা না, বাংলাদেশে এখন অনেকেই কাজ করছেন। আমাদের সবারই প্রচেষ্টা বৈশ্বিক প্লাটফর্মে বাংলাদেশকে তুলে ধরা।

বাইরের দেশের আর্ট কালেক্টররা বাংলাদেশের শিল্পকর্ম ও শিল্পীদের নিয়ে কতটা আগ্রহী?

বিশ্বজুড়েই দক্ষিণ এশীয় আর্টের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। আগে ইস্ট তাকাত ওয়েস্টের দিকে। এখন পশ্চিমের ওরা পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাংলাদেশ এ উপমহাদেশের মধ্যে ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের শিল্পকর্ম, কারুশিল্প, লোকশিল্প ঘিরে বিদেশে আগ্রহের কমতি নেই। তবে শুধু আগ্রহ থাকলেই হবে না, এ কাজগুলো নিয়ে যারা এগিয়ে আসতে চাচ্ছে, আমাদের দেশ থেকে আমরা তাদের কতটা সহযোগিতা করতে পারছি, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। 

বাইরের দেশের আর্ট মার্কেটের সঙ্গে আমাদের দেশের শিল্পীরা কতটা সংযুক্ত হতে পারছেন?

সময়টা বিশ্বায়নের। আমাদের দেশের শিল্পের প্রচার ও প্রসার দুটোরই দরকার আছে। বাইরের দেশে আমাদের দেশের ঐতিহ্য, কারুশিল্প, লোকশিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন। কে কতটুকু নিজেকে প্রচার করতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে তার খ্যাতি বাড়ছে। আর্ট মার্কেট সম্পর্কে আমি মনে করি, বাংলাদেশেই তো আমরা আমাদের আর্টের বাজার তৈরি করতে পারিনি। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে যদি শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হঠাৎ করে শিল্পকর্ম কেনা শুরু করে, তাহলে তো বাজারে সংকট শুরু হয়ে যাবে। বিদেশের বাজার দেখার আগে দেশের বাজার দেখা উচিত।

তরুণ শিল্পীরা অনেক সময় অভিযোগ করেন যে শিল্প সংগ্রাহকেরা ঘুরেফিরে বিখ্যাত শিল্পীদের কাজ সংগ্রহ করেন?

আমি পুরোপুরি বিষয়টার সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করব না। শিল্পীর নিজেরও কিন্তু তার কাজ সবার কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব রয়েছে। শিল্প সংগ্রহ কিন্তু কোনো চ্যারিটি না। অনেক টাকা দিয়ে কাজগুলো কিনতে হয়। তরুণ শিল্পীদের উদ্দেশে আমি বলব গ্যালারি সঙ্গে, শিল্প সংগ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। পাশাপাশি তাদের কমিটমেন্টও থাকা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন