কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়লেও বছরজুড়ে অস্থির ছিল বাজার

শাহাদাত বিপ্লব

বিশ্ববাজারে খাদ্য ও কৃষিপণ্যের দাম কয়েক মাস ধরেই নিম্নমুখী। আবার দেশেও এসব পণ্যের উৎপাদন বাড়ছে বলে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে উঠে আসছে। যদিও দেশের বাজারে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) প্রায় পুরো সময়জুড়েই মারাত্মক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে কৃষিপণ্যের দাম। 

দেশে আলু-পেঁয়াজের মতো কিছু খাদ্যপণ্যের উৎপাদন হচ্ছে চাহিদার চেয়ে বেশি। এর পরও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য দুটির দাম  ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত এক বছরে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৯৩ শতাংশ। আলুর দাম বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। অন্যান্য খাদ্য ও কৃষিপণ্যের বাজারেও একই পরিস্থিতি। এক বছরের ব্যবধানে আদা ও চিনির দাম বেড়েছে যথাক্রমে ২১২ ও ৬৪ শতাংশ। 

প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজারও অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেষ দিক পর্যন্ত মারাত্মক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে এসব কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, যুদ্ধের দোহাই দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করা হয়েছে। বাজারে যথাযথ নজরদারি না থাকায় খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।

দেশে চালের জোগানের সিংহভাগই আসে বোরো ও আমন মৌসুম থেকে। আর অল্প জোগান আসে আউশ মৌসুমে। এ বছর বোরো ও আমন দুই মৌসুমেই গত বছরের চেয়ে ফলন হয়েছে অনেক বেশি। তবু ২০২২ পঞ্জিকাবর্ষের প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে ৫-৬ শতাংশ। বোরো মৌসুমে অবশ্য চালের বাজার আগের দামেই ফিরে আসে। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত অর্থবছরের চেয়ে এবার ২৫-৩০ লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের তিন মৌসুম মিলিয়ে মোট ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ১ লাখ, আমনে ১ কোটি ৪৯ লাখ ও আউশে উৎপাদন হয় ৩২ লাখ টন চাল। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৪ কোটি ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে আউশ মৌসুমে ২৯ লাখ ও আমনে চাল উৎপাদন হয় ১ কোটি ৭০ লাখ টন। আর বোরো মৌসুমে এ পর্যন্ত ৯৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ফসল কাটা হয়েছে। এতে ফলন হয়েছে ২ কোটি ৫ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদন বেশি হওয়ায় চালের জোগান এবার পর্যাপ্ত। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বাংলাদেশে পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরবরাহ বা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে তা কমেনি, বরং বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দাদন ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, মিল মালিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগীরা কাঠামোগতভাবে মূল্য নির্ধারণ করেন। আবার খুচরা ও পাইকারি বাজার মিলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের নেটওয়ার্ক রয়েছে, যারা বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করেন। ফলে সরবরাহের সঙ্গে দামের যে সম্পর্ক, সেটা দেখা যায় না। কৃষক দাম পান না। সরবরাহ বাড়া-কমার সঙ্গে দাম নির্ধারণ হবে, এটাই অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু এর মাধ্যমে দাম নির্ধারণ না হয়ে ক্ষমতা ও ক্ষমতার সঙ্গে ভাগাভাগি করে দাম নির্ধারণের কারণে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চলমান। এর কারণে নতুন দরিদ্রও বাড়ছে। আবার ভোক্তাকে স্বস্তি দেয়ার জন্য সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ করা হলেও পরে তা আর সমন্বয় করা হয় না। বাজারে এক ধরনের একচেটিয়া ব্যাপার গড়ে উঠেছে।’ 

দেশের বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজ ও আলুর দাম। দুটি পণ্যই চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদন হয়েছে। ডিএইর হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন, যেখানে চলতি বছর উৎপাদন হয় সাড়ে ৩৪ লাখ টনেরও বেশি। সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে পেঁয়াজ ঘরে তোলেন কৃষক। এরপর জুন-জুলাই পর্যন্ত তা সংরক্ষণে রেখে বিক্রি করা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ মজুদ থাকে। তবে এ বছর দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকেই বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যটির দাম। ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি পেঁয়াজের বর্তমান দাম ৭০-৮০ টাকা। মাঝে কিছুদিন প্রতি কেজি ৯০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে।

আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টন। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টন, যেখানে গত অর্থবছরে হয়েছিল ১ কোটি ১ লাখ টন। চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি জোগান থাকার পরও দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। যদিও গত বছরের এ সময়ে আলুর কেজি ছিল ২০-২৫ টাকা। 

সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের সংরক্ষণ দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে উৎপাদন বেশি হলেও সুফল মেলে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টাকার মান কমেছে। এতে স্থানীয় কেনাকাটায়ও প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সেই যুদ্ধের প্রভাব না পড়ার কথা থাকলেও এর প্রভাব পরোক্ষভাবে কিন্তু পড়েছে। আবার যুদ্ধের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমেও মূল্য বাড়িয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাই এখন সে কথা বলছেন। সিন্ডিকেশন এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে এটা থেকে বের হয়ে আসা কঠিন। ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে এ থেকে বের হয়ে আসতেই হবে।’ 

এছাড়া ডিএইর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর দেশে শাকসবজি উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১৬ লাখ টন। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। তেলবীজ জাতীয় ফসল গত বছরের চেয়ে প্রায় দুই লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে আগের বছরের চেয়ে প্রায় চার লাখ টন বেশি। প্রায় দুই লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে গম। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী বাড়তি সরবরাহ বাড়লে মূল্য কমার কথা থাকলেও তা এখন দেশের বাজারে খাটছে না। 

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন)। তবে তা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের পিংকশিটের তথ্যানুযায়ী, ওই সময় প্রতি টন গমের দাম ৩৪২ দশমিক ৯ ডলার হলেও এ বছরের এপ্রিলে ছিল ২৯১ দশমিক ১ ডলার। সয়াবিন তেলের দাম গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি টন ছিল ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। যদিও চলতি বছরের এপ্রিলে দাম নেমেছে ১ হাজার ৩০ ডলারে। যদিও দেশের বাজারে কমার বদলে উল্টো দাম বেড়েছে। 

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে কোনো ছাড় নেই। উল্টো যেগুলো আমরা নিজেরা উৎপাদন করি সেগুলোরও দাম বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অজুহাত মাত্র। একসময় বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছিলেন। এখন বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় তারা লোকসানে পড়ে গেছেন, দাম কমাতে পারছেন না। পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজার তদারকির মধ্যে নেই। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই যদি প্রতিটি পণ্যের দাম এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে তো বড় সমস্যা। দেশীয় উৎপাদনের সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক কী? মূলত সরকারের মনিটরিং দুর্বলতার কারণে এভাবে দাম বাড়ছে। নইলে মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই বর্তমানে।’

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বর্তমানে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৮ টাকায়। গত বছরের এ সময়ে পণ্যটির দাম ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। খোলা ময়দা প্রতি কেজির বর্তমান দাম ৫৮-৬৫ টাকা, যা গত বছরের এ সময়ে ছিল ৫৮-৬০ টাকা। প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম গত বছরের এ সময়ে ১৮২-১৯০ টাকা থাকলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮৫ টাকায়। ৮০-১২০ টাকা কেজির দেশী রসুন বর্তমানে ১৪০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশী আদার দাম প্রতি কেজি ১০০-১৪০ টাকা থাকলেও বর্তমানে কিনতে হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকায়। এছাড়া বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৪০ টাকায়, যা গত বছরের এ সময়ে ছিল ৭৮-৮০ টাকা। ১৪০-১৬০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি এক বছরের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকায়। ডিম গত বছরের এ সময়ে প্রতি হালি ৩৮-৪৩ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ৪৭-৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে। আর প্রতিটি জায়গায় পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূলত বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। পাবনায় গিয়ে দেখেছি, কৃষকের বাড়িতেই পেঁয়াজের দাম বেশি। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ যুক্ত হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সার্বিক মূল্যস্ফীতিরও একটা প্রভাব রয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন