তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা

খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা হোক

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপ সংস্কৃতি এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়লেও খেলাপিদের বিরুদ্ধে নেই শাস্তি বা তিরস্কারের ব্যবস্থা। উল্টো খেলাপিদের দেয়া হয় বিভিন্ন ধরনের সুবিধা। যেমন সুদ হ্রাস, মেয়াদ বৃদ্ধি ইত্যাদি। দেখা গেছে, এসব সুবিধা পেয়ে তারা আর ঋণ শোধ করেন না; বরং মনে করেন খেলাপি হলেই বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। এর ফলেই যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। ঋণখেলাপিদের শাস্তি না হওয়ায় দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ বিদেশে টাকা পাচার করেন, কেউবা সেই টাকা খাটান পুঁজিবাজারে। কেউ এক খাতে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন অন্য খাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রবণতা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। খেলাপি ঋণের বিস্তার রোধ এবং অনাদায়ী ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা হয়। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে ঋণ দেয়া এবং সময়মতো সে ঋণ আদায় করা। ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হলো এ ঋণ। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ, কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগসহ শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। ব্যাংকের সঙ্গে যাদের লেনদেনের সম্পর্ক তারা বেশির ভাগই শিক্ষিত, সচেতন; সবারই চোখ-কান খোলা। সবাই জানে ও বোঝে, প্রশিক্ষিত ও সৎ কর্মকর্তার সমন্বয়ের সঙ্গে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ছাড়া কোনো ব্যাংক সাফল্য অর্জন করতে পারে না। অতীত ও বর্তমানে ব্যাংক খাতে লুটপাটের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট না থাকার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংক খাত। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম রেখে সুষম উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। সুশাসনের অভাব, উচ্চ করহার, আর্থিক অপরাধ ও চুরি এবং নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিন দিন। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংক খাতকে ইতিবাচক ধারায় রাখা এবং কোম্পানি, বীমাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সৎ ও সহজ বোঝাপড়া দরকার, এটি যেন কেউই মনে করেন না।

খেলাপি ঋণ আদায়ে কিছু বিষয় সুবিবেচনায় আনা প্রয়োজন। প্রথমত, ঋণ বিতরণ ও আদায়ে সমতা বিধান করা। ঋণ বিতরণ যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতে হয় তাহলে আদায়ের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ব্যাপারে ব্যাংকার-গ্রাহকের নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, যারা অসাধুতাকে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত করে তারা উভয়ই সমান দায়ী। এ ব্যাপারে প্রথমে ব্যাংকারদের সতর্ক হতে হবে এবং পরে গ্রাহককেও এ পথ অনুসরণ করতে হবে; দ্বিতীয়ত, দেশের বেসরকারি ও সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণত আর্থিক বাজারের অংশ হিসেবে স্বল্পমেয়াদে গ্রহীতাদের ঋণের চাহিদা পূরণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এ ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে ৪-৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে, যার বেশির ভাগ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিয়মনীতি ভঙ্গ করে ঋণ দেয়া এবং খেলাপি ঋণের যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছে। ফলে তারল্য সংকট, মুনাফার ঘাটতি ও ইমেজ সংকট তৈরি হচ্ছে। অথচ দীর্ঘমেয়াদে বড় কোনো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ব্যাংক, যেমন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), বেসিক ব্যাংক, রাকাব ইত্যাদি রয়েছে, যারা সরকারি ব্যাংক হিসেবে সরকারের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বেশি সময়ের অর্থায়নে অংশ নিতে পারে। এ অসংগতিগুলো দূর করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ব্যাংক খাতের বৃহদাকার ঋণগুলোর স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেক অলাভজনক খাতেও ঋণ বিনিয়োগ হচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ঋণ অনুমোদন হয়, যার বেশির ভাগ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যায়, পরিণতি হয় খেলাপি ঋণ। চতুর্থত, ঋণ মওকুফ, ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ, ঋণের অবলোপন বিষয়গুলো এখন খুব ক্ষতিকর ও অলাভজনক। ব্যাংকও ঢালাওভাবে সবাইকে সুযোগ দিতে পারে না কিংবা ঢালাওভাবে বিবেচনায়ও আনতে পারে না। কিন্তু জায়গাটিতে ব্যাংকার কিংবা ব্যাংকিং সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়, যা কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। 

দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে খেলাপি ঋণ আজকে বিপর্যয়কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রধানত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কারণেই ব্যাংক খাতের বর্তমান সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অথচ কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এতে অন্যরাও দুষ্কর্মে উৎসাহিত হচ্ছে। কাজেই খেলাপি ঋণের বিস্তার কমাতে হলে দেশে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ নয়; প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলোও প্রতিরোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা খেলাপি ঋণ রোধ ও আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় নানা সময়ে কিছু সুপারিশ করে এসেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্যাংক খাতের জন্য ন্যায়পাল নিয়োগ, মন্দ ঋণ আদায়ের জন্য ‘ডেট রিকভারি বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি’ গঠন, অর্থঋণ আদালতে কোনো রায় হলে সরাসরি সম্পত্তি জব্দ করার সুযোগ, অর্থ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রদান, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা, একীভূতকরণের সুযোগ সৃষ্টি; সর্বোপরি একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন। 

ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা সুশাসনের ঘাটতি। ব্যাংক খাতে কারসাজি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, পরিচালকদের মধ্যে আন্তঃব্যাংক ঋণ আদান-প্রদান, ব্যাংক পরিচালনা থেকে শুরু করে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের আরো সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে সবাই। ব্যাংক খাতের জন্য যেসব নীতিমালা, আইনকানুন, আন্তর্জাতিক রীতি আছে, সেগুলো সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক খাত জড়িত। এ খাতের উন্নয়ন না হলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। আর্থিক কাঠামো দুর্বল হবে। ব্যাংক খাতের এ দুর্দশা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এ খাতকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা এখন খুবই জরুরি। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়াই শুধু দায়ী নয়, এর পেছনে আরো অনেক কারণ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলেও জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এ প্রেক্ষাপটে ঋণখেলাপিদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে ব্যাংক কোম্পানি আইন কঠোর করার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। 

ব্যাংক খাতকে যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বিবেচনা করা হয়। আর সে খাতই যদি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য, যার আলামত নানাভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাজেই বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে যথাসম্ভব দ্রুত ব্যাংক খাতকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পড়বে ব্যাংক খাতে অভ্যন্তরীণ নৈতিকতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা। একটি শক্তিশালী নৈতিক সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যদি আবারো বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলেই ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন