রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে এক্সপ্রেসওয়ের ৩১ র‍্যাম্প

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কি যানজট বাড়িয়ে দেবে?

শামীম রাহমান

নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য যানজট কমিয়ে আনা। প্রকল্পটির কাজ যখন মাঝপথে, তখন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে বলা হচ্ছে মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্টে যানজট বাড়িয়ে দেবে এ প্রকল্প। বিশেষ করে বনানীর কাকলী ও বুয়েটসংলগ্ন পলাশী এলাকায় নির্মাণাধীন ও নির্মিতব্য এক্সপ্রেসওয়ের দুটি র‌্যাম্প (ওঠা-নামার সংযোগ পথ) নিয়ে আপত্তি তুলেছে সংস্থা দুটি। আপত্তি ওঠা এসব বিষয় নিয়ে আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি সূত্র। সভায় যানজটের আশঙ্কার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে সূত্রটি।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কাকলী ও পলাশী এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে যানজটের আশঙ্কা করলেও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি র‌্যাম্পই ঢাকার যানজট বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এমনকি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ২০১৪ সালে করা পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) প্রতিবেদনেও এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়কের যে অংশে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা বা নামার র‌্যাম্প নামানো হবে, সেসব স্থানে (র‌্যাম্প টাচ-ডাউন পয়েন্টস) যানজট দেখা দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যে ঢাকার যানজট বাড়িয়ে দেবে, তার একটি বড় উদাহরণ হতে পারে কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ের জন্য করা প্রকল্পটির নকশা। মূলত এ মোড় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের সংযোগস্থল। এর ওপর দিয়ে গেছে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল। রয়েছে একটি এলিভেটেড মেট্রো স্টেশনও। পাশাপাশি সোনারগাঁও হোটেলের সামনে এসে নেমেছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের একটি র‌্যাম্প। এ মোড়কে ঘিরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য আরো দুটি র‌্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে। একটি দিয়ে যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করবে, আরেকটি দিয়ে বের হবে। 

তারা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বের হওয়া যানবাহনগুলো সোনারগাঁও মোড়ে বাড়তি চাপ তৈরি করবে। একইভাবে সোনারগাঁও মোড় হয়ে যেসব যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে, সেগুলোও চাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। আবার এক্সপ্রেসওয়ের জন্য দুটি র‌্যাম্প তৈরি করা হলে সোনারগাঁও মোড়ের যানবাহন ধারণক্ষমতাও কমে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিপথের একটি বড় অংশ পড়েছে বিমানবন্দর-কমলাপুর রেলপথ বরাবর। এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল করিডোরের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ মূল করিডোরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য তৈরি করা হচ্ছে ৩১টি র‌্যাম্প। এর মধ্যে ১৫টি র‌্যাম্প এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য। আর নামার র‌্যাম্প বা পথ ১৬টি।

ঢাকার বিমানবন্দর/কুর্মিটোলা, কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, বিজয় সরণি, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া এবং পলাশী মোড় থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে যানবাহন। বিপরীতে বিমানবন্দর/কুর্মিটোলা, কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ, সেনানিবাস, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া, ইন্দিরা রোড ও পলাশী মোড় দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে যানবাহন বের হবে।

প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য করা সমীক্ষা অনুযায়ী, পুরোদমে চালু হওয়ার পর প্রত্যেকটি ওঠা-নামার র‌্যাম্প দিয়ে ঘণ্টায় ৯০০ যানবাহন চলতে পারবে। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, এ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার-জিপের মতো হালকা যানবাহন, বাস ও ট্রাক চলাচল করবে। দুই ও তিন চাকার যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করতে পারবে না। 

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামার প্রত্যেকটি র‌্যাম্পই যানজট বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শহরের যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার যে সমাধান দেয়ার বদলে উল্টো যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে, এর উদাহরণ হলো ঢাকার বিভিন্ন ফ্লাইওভার। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্পগুলোও একই অবস্থা তৈরি করতে যাচ্ছে। র‌্যাম্পের কারণে ঢাকার যানজট বাড়বে না কমবে, সে বিতর্কগুলো আমরা ২০১০ সালের দিকেই করেছি। কিন্তু সরকার আমাদের কথায় কান দেয়নি। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি এগিয়ে নিয়েছে।’

বর্তমানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প থেকে বের হয়ে আসার কিংবা নির্মাণাধীন ও এরই মধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া র‌্যাম্পগুলো থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পটি কিন্তু সরকার নিজের টাকায় করছে না। করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে। বিনিয়োগকারীরা লাভের হিসাব করেই শহরের ভেতরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প তৈরি করছে। তাদের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী র‌্যাম্পগুলো বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবার ঢাকার এ প্রকল্পটির সঙ্গে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পও জড়িয়ে গেছে। এখন প্রকল্প দুটি একটি আরেকটির পরিপূরক হয়ে উঠেছে।’

এর আগে ৮ মে অনুষ্ঠিত ‘ঢাকা মহানগরীতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প সমন্বয়’ কমিটির এক সভায় (ডিএসসিসি) বলা হয়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক ও রেললাইন বরাবর শহরের বাইরে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে শহরের ভেতরের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাম্প নামানো হচ্ছে। এতে শহরের ওপর যানবাহনের চাপ আরো বাড়বে। বিশেষ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‌্যাম্পের কারণে পলাশী এলাকায় যানবাহনের চাপ বহু গুণ বেড়ে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়। একই সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে বলা হয়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাকলী ইন্টারসেকশন সংলগ্ন ডাউন র‌্যাম্পটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নামানো হলে সংলগ্ন এলাকায় যানজট বাড়বে।

এ বিষয়ে গতকাল যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সেলফোন বন্ধ পাওয়া যায়। একাধিকবার চেষ্টা করেও সেতু বিভাগের সচিবের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ৮ মের সভার পর স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘র‌্যাম্প দেয়াটাকে আপাততভাবে আমরা মনে করি যে ট্রাফিক সলিউশনে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমরা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের পর বুঝতে পারব। বাস্তবতার ভিত্তিতে আমরা পরে সিদ্ধান্ত নেব।’

৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি তৈরি করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক কনগ্লোমারেট প্রতিষ্ঠান ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠন করা হয়েছে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের একটি বেসরকারি কোম্পানি। নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে এ কোম্পানি।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে তিন অংশে তৈরি করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা (বিমানবন্দর) থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। বনানী থেকে মগবাজার অংশের কাজ ৫০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত অংশের অগ্রগতি ৫ শতাংশ। পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন