তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা

হাছান আদনান

দেশের ব্যাংক খাতে নতুন রেকর্ড গড়েছে খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের মার্চ শেষে ফেরত না পাওয়া এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকায়। ব্যাংক খাতে এত পরিমাণ ঋণ খেলাপি হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম। শুধু চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই ১০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর গত এক বছরে বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকার। খেলাপি ঋণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়টিও রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি হওয়া ঋণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে জোর তাগিদ দিয়ে আসছে বহুজাতিক সংস্থাটি। যদিও প্রাপ্ত তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমার চেয়ে উল্টো বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এতদিন দেশের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ নিয়ে শীর্ষে ছিল সোনালী ও জনতা ব্যাংক। এবারই প্রথম শীর্ষ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে অগ্রণী ব্যাংকের নাম।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা ছিল খেলাপি, যা দেশের ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে ১৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ফেরত না পাওয়া ঋণের পরিমাণ ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশই এখন খেলাপি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত তিন বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৩১ কোটি টাকায়। দেশে কার্যরত বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা। বাকি ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। 

খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. জাকির হোসেন চৌধুরী। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত তিন বছর বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্য দিয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের নীতি ছাড়ের কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন নীতি ছাড়ের মেয়াদগুলো শেষ হয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা বাড়ছে। ব্যাংকগুলো এখন নিজেরাই খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিবেচনা না করে হার বিবেচনায় নিলে সেটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে যায়নি।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ এখন অগ্রণী ব্যাংকের। চলতি বছরের মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির খেলাপি হওয়া ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশই এখন খেলাপি। যদিও এক বছর আগেও অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। 

অগ্রণী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস-উল-ইসলাম নিজের পদ টিকিয়ে রাখতে প্রভাবশালী কিছু গ্রাহককে বাছবিচার ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়ে গেছেন। সেসব ঋণ এখন আর ফিরে আসছে না। এ কারণে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আগামীতে ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি বেসিক ব্যাংকের পর্যায়ে চলে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন ওই কর্মকর্তারা।

খেলাপি ঋণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের নাম। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। জনতার বিতরণকৃত ঋণের ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ এখন খেলাপি। তবে গত এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ অনেকটাই কমেছে। দুই বছর আগেও এর পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত গিয়ে উঠেছিল। 

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৬ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ঊর্ধ্বমুখী। মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। লুণ্ঠনের শিকার হওয়া বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখনো ৫৮ শতাংশের বেশি। ব্যাংকটির ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে খেলাপির খাতায়।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৭ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে শীর্ষস্থানে আছে ন্যাশনাল ব্যাংকের নাম। দেশের প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। যদিও ন্যাশনাল ব্যাংকের ২০২২ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।

দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ১০১ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৪ শতাংশ এখন খেলাপি। আর এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এছাড়া বিপর্যস্ত পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) খেলাপি ঋণের হার এখনো ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। ব্যাংকটির ৩ হাজার ৪২৭ কোটি টাকার ঋণ খেলাপির খাতায়। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ২২ শতাংশ।

খেলাপি ঋণের হারকে বিবেচনায় নিলে সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থানে থাকা ব্যাংক হলো বিদেশী খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৯৮ শতাংশই খেলাপি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৮৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৩ শতাংশের বেশি।

কভিডসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা দিতে ২০২০ সালে নজিরবিহীন নীতি ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই বছর ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করেই খেলাপি হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন গ্রাহকরা। নীতি ছাড়ের ছড়াছড়ি ছিল ২০২১ সালজুড়েও। গত বছরও ঋণগ্রহীতারা নীতি ছাড়ের বেশকিছু সুফল ভোগ করেছেন। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামাল দিতে গত বছর ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালায় অনেক সহজ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের হাতেই পুনঃতফসিলের সব ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়েছে। নজিরবিহীন নীতি ছাড়ের পর ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের হার বাড়িয়েছে। তার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের হিসাব গণনা করে সেটি সঠিক নয় বলে মনে করে আইএমএফ। ২০১৯ সালে এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলেছিল, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা হয়েছে। ফেরত না আসা ঋণের যে পরিমাণ ব্যাংকগুলো দেখায়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার চেয়ে অনেক বেশি। আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন