সাক্ষাৎকার

১০০ মিলিয়ন ডলারের জুতা রফতানি করতে চাই

সাদাত হোসেন সেলিম

প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড

দেশের চামড়া খাতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন সাদাত হোসেন সেলিম। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড। রফতানিমুখী এ কোম্পানিটি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের চামড়া খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি ও নিজ প্রতিষ্ঠানের নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) স্মল ক্যাপ মার্কেটে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে ক্রাফটসম্যান ফুটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে জানতে চাই। এর যাত্রা শুরু হলো কীভাবে?

২০১৭ সালে প্রথমে শ্রীপুরে আমার নিজের জমিতে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে একটি ছোট কারখানা করি। আমরা শুরুর দিকে জুতা স্যাম্পলিং করতাম। আমরা কিছু জুতার প্রোটোটাইপ স্যাম্পলিং করে সেগুলো বাইরে পাঠানো শুরু করলাম। দেখলাম যে ভালো সাড়া পাওয়া গেল। থেকে অনুপ্রাণিত হলাম যে বড় কিছু করব। ২০১৮ সালে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জমি কিনে প্রায় এক লাখ বর্গফুট জায়গার ওপর নতুন একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করলাম। যন্ত্রপাতি এনে কারখানাটি স্থাপন করতে দুই বছর সময় লেগে গেল। ২০২০ সালে কারখানার কাজ যখন শেষ হয়ে আসে তখন কভিড-১৯-এর সংক্রমণ শুরু হলো। বিশ্ব দেশের অর্থনীতি তখন স্থবির স্তব্ধ। সেই অবস্থায় আমাদের কারখানার যাত্রা শুরু। ২০২১ সালে আমরা কিছু কার্যাদেশ পেলাম। প্রথম যাত্রায় ইতালির দুজন ক্রেতার কাছে ২৮ হাজার জোড়া জুতা সরবরাহ করলাম। আমাদের প্রথম পণ্য পাওয়ার পর ওরা খুব খুশি হলো। ২০২২ সালে আমরা প্রায় চার লাখ জোড়া জুতা রফতানি করেছি। বছর এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ জোড়া শীতকালের জুতার কার্যাদেশ আছে। গ্রীষ্মকালে আরো কার্যাদেশ পাব। আমাদের প্রত্যাশা বছর আমরা ছয় লাখ জোড়া জুতা রফতানি করব। সামনে আমাদের ব্যবসা আরো বাড়বে। আমাদের বিপণন ভালো, আমরা দক্ষ শ্রমিকদের নিয়ে এসেছি। আমাদের কারখানায় ইতালির টেকনিশিয়ান রয়েছেন, তিনি আমাদের দিকনির্দেশনা দেন। আমাদের ডিজাইন ল্যাবরেটরিটি ইতালিতে, তারা আমাদের সাহায্য করে। যেহেতু আমি নিজে চামড়া চিনি তাই ক্রেতার চাহিদা অনুসারে চামড়া সংগ্রহ করে সেটি দিয়ে জুতা বানানোটা আমার জন্য সহজ। ভবিষ্যতে আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা রয়েছে যে আমাদের সক্ষমতা ১০ লাখ জোড়ায় নিয়ে যাওয়ার। ২০২৪ সালেই আমরা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে চাই। কারণেই আমরা তহবিল সংগ্রহের জন্য ব্যাংকে না গিয়ে পুঁজিবাজারে আসতে চাইছি। যেহেতু আমাদের মূলধন ছোট, কারণে আমরা প্রথমে স্মল ক্যাপ প্লাটফর্মে আসতে চাইছি। কয়েক বছর সেখানে থাকার পর আমরা পুঁজিবাজারের মূল প্লাটফর্মে যাব। তাছাড়া দেশের বাইরে তালিকাভুক্ত কোম্পানি গ্রহণযোগ্যতা বেশি এবং একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করে। মূলত দুই কারণেই আমরা পুঁজিবাজারে আসতে চাইছি।

সামনের দিনগুলোতে আপনারা ১০ লাখ জোড়া জুতা বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। বাংলাদেশের জুতা রফতানির বাজার মূলত কোন অঞ্চলকেন্দ্রিক?

আমাদের জুতার বাজার হচ্ছে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র কানাডা) জাপান। আমাদের লক্ষ্য আছে আমরা একসময় চীনেও চামড়ার জুতা রফতানি করব। চামড়া আমাদের দেশের বিশাল বড় সম্পদ। কোরবানির ঈদের সময় আমরা শুনেছি যে অনেক চামড়া পুঁতে ফেলে। ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিটাকে যদি আমরা বড় করতে পারি সঠিকভাবে। আমাদের ট্যানারির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশন। হেমায়েতপুরে যে চামড়া শিল্পনগরী করা হয়েছে, সেটার ইটিপি ঠিকমতো কাজ করে না। এটিকে যদি আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা ঠিক করতে পারি। আমাদের এখানে যদি ২০টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সার্টিফায়েড হয়ে যায়, তাহলে আমরা বিশ্বের অনেক বড় ক্রেতাদের কাছ থেকে কার্যাদেশ পাব।

একটা সময় পর্যন্ত তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়া খাত থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রফতানি আয় আসত। কিন্তু এক পর্যায়ে সেটি কমে যায়। কেন?

মূলত ইটিপির কারণেই এটি কমে গেছে। চামড়ার জুতার বাইরেও চামড়াজাত পণ্যের একটি বড় বাজার রয়ে গেছে। বৈশ্বিকভাবে এসব পণ্যের অনেক চাহিদা আছে। আমাদের একটি ছোট ইউনিট আছে চামড়াজাত পণ্যের। স্থানীয় বাজারে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। আমাদের পরিকল্পনা আছে এটিকে রফতানিমুখী করার। চামড়াজাত পণ্যের একটি বড় বাজার হচ্ছে জাপান। আমরা ইচ্ছে করলে ইউরোপের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে পারি। কিন্তু এজন্য সবার আগে চামড়া খাতটির উন্নয়ন করতে হবে।

বর্তমানে আপনারা কোন ধরনের পণ্য উৎপাদন করছেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাই?

আমরা জুতার ওপরই ফোকাস করতে চাই। জুতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। আমরা সব ধরনের জুতা তৈরি করি না বলে ক্রেতারা আমাদের সেগুলোর কার্যাদেশ দেয় না। আমরা করতে পারলে তারা অবশ্যই কিনবে। আমরা বর্তমানে পুরুষ নারীদের জুতা তৈরি করি। আমাদের পরিকল্পনা আছে বাচ্চাদের জুতা তৈরি করার। এটির বেশ বড় বাজার রয়েছে। সেফটি সু যেগুলো শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়, এসব জুতার ভালো চাহিদা রয়েছে।

তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে দেখা যায় বিলাসবহুল পণ্যে ভালো দাম পাওয়া যায়। জুতার ক্ষেত্রেও কি একই বিষয় প্রযোজ্য?

শুরুতে আমরা কিন্তু বেসিক গার্মেন্টসই তৈরি করেছি। পরবর্তী সময়ে আমরা সেখানে মূল্য সংযোজন করেছি। একইভাবে বর্তমানে আমরা বেসিক ধরনের জুতা বানাচ্ছি। ধীরে ধীরে আমরা দামি জুতার দিকে যাব। বর্তমানে আমরা ২০-২২ ডলারের জুতা তৈরি করছি। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে ভবিষ্যতে ৪০-৪৫ ডলার মূল্যের জুতা তৈরি করার।

আপনারা বর্তমানে কোন কোন দেশে জুতা রফতানি করছেন?

বিশ্বের আটটি দেশে আমাদের উৎপাদিত জুতা রফতানি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ইতালি জার্মানি আমাদের মূল বাজার। এছাড়া বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র জাপানে আমাদের জুতা বিক্রি হয়। আমরা বাটা ইতালি বাটা চেকোস্লোভাকিয়ার জন্য জুতা বানাই। জার্মানির ডায়েখম্যান, বেলজিয়াম ডাচ ব্র্যান্ড রোজেন, ডেনমার্কের নিয়েলসন, জার্মানির হাসপাপির মতো ব্র্যান্ডের জুতা আমরা তৈরি করেছি।

ভবিষ্যতে আর কোন কোন দেশে রফতানি করতে চান?

জাপানের বাজারে আমি রফতানি বাড়াতে চাই। সেখানকার বাজারটা একটু অন্যরকম ভালো দাম পাওয়া যায়। উত্তর আমেরিকার বাজারও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানকার বেশ কিছু ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে চায়। যদি আমরা চামড়ার ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স অর্জন করতে পারি তাহলে তাদের বাজার ধরতে পারব।

আপনারা কি রফতানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন নাকি স্থানীয় বাজারেও জুতা বিক্রি করতে চান?

আমরা মূলত রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান। আমাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউস আছে। বন্ডের সুবিধার আওতায় আমরা বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করি। স্থানীয় বাজারও বেশ বড়। এখনো আমরা ৩০-৩৫ শতাংশ জুতা চীন থেকে আমদানি করে থাকি। কিন্তু স্থানীয় বাজারে জুতা বিক্রি করতে হলে আমাদের আলাদা কারখানা করতে হবে। দেশে বর্তমানে বাটা এপেক্সের বাইরে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড নেই। ফলে এখানেও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদেরও পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে নতুন কারখানা স্থাপন করে স্থানীয় বাজারে জুতা বিক্রি করার। আমাদের বর্তমানে একটি নন বন্ডেড ছোট কারখানা আছে। এখানে সীমিত পরিসরে কিছু জুতা উৎপাদন করা হয়। এসব জুতা আমরা ইউনিমার্টের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছি।

আপনাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?

বর্তমানে বছরে আমাদের ছয় লাখ জোড়া জুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আমরা আরো দুই লাখ জোড়া জুতা উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে চাই। এজন্যই স্মল ক্যাপ প্লাটফর্মে তালিকাভুক্ত হয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে চাইছি। কয়েক বছর পর মূল মার্কেটে তালিকাভুক্ত হয়ে আরো বড় অংকের অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বড় আকারে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে আমাদের।

ভবিষ্যতে কি আপনাদের ট্যানারি স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা আছে?

আমি অনেক সময় প্রত্যাশিত মানের চামড়া পাই না। আমাদের ট্যানারি শিল্প বেশ পুরনো। এখানে সাধারণ মানের চামড়া তৈরি হয়। এখনো আমরা অ্যাডভান্সড মানের চামড়া বানাতে পারি না। আমি নিজেও ট্যানারি শিল্পে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ট্যানারির প্রতি আমার নিজেরও আগ্রহ আছে। আমি নিজে চামড়া তৈরি করতে পারলে ক্রেতাকে সঠিক মানের পণ্য আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে সরবরাহ করতে পারব। বর্তমানে আমাকে চামড়ার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমার বর্তমান উদ্যোগগুলো একটা পর্যায়ে আসার পর তখন আমি ট্যানারি শিল্পে বিনিয়োগে যেতে পারব। তবে আমার ইচ্ছা আছে ট্যানারি স্থাপনের।

আগামী পাঁচ বছর আপনার প্রতিষ্ঠানকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?

বর্তমানে আমরা ১০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করছি। আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এটি ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের ভালো চামড়া দরকার। ভালো চামড়ার জন্য ট্যানারিগুলোকে উন্নত করতে হবে এবং এলডব্লিউজি সার্টিফিকেশনের জন্য ইটিপি করতে হবে। এগুলো করা সবচেয়ে বেশি জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন