চট্টগ্রামে খামারভিত্তিক বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের ফলে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সাধারণ গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছেন বায়োগ্যাস। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও পটিয়া উপজেলায় গরুর খামার বেশি থাকায় বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন খামারিরা। তবে বায়োগ্যাস সরবরাহ ২৪ ঘণ্টা পাওয়া গেলেও দাম একটু বেশি মনে করছেন ব্যবহারকারীরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি হলেও ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে চট্টগ্রামে বায়োগ্যাস ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন বাণিজ্যিক ও সাধারণ গ্রাহক। কারণ এটি ব্যবহারে সিলিন্ডারের মতো বিস্ফোরণের ঝুঁকি নেই। এমনকি যত ইচ্ছা তত ব্যবহার করা সম্ভব। তবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকায় খাতটিতে উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটেনি।
২০০৭ সালের দিকে চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া উপজেলার শিকলবাহা এলাকায় খামারভিত্তিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুরু হয় বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। তবে পরবর্তী সময়ে নতুন কর্ণফুলী উপজেলা গঠিত হলে বেশির ভাগ বায়োগ্যাস প্রকল্প কর্ণফুলী উপজেলার অন্তর্গত হয়।
কর্ণফুলী উপজেলাকে বলা হয় গরুর খামারের উপজেলা। এ উপজেলার শিকলবাহা এলাকায় মূলত ছোট বড় খামারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আছে দেড় হাজারের মতো গরুর খামার। বায়োগ্যাস প্লান্টের সংখ্যা প্রায় ৯৫০। উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার। এছাড়া পটিয়ার কচুয়াই, হাইদগাঁও, জঙ্গলখাইন, জিরি এলাকায় পাঁচ শতাধিক বায়োগ্যাস প্লান্ট, বোয়ালখালীতে আড়াইশ, আনোয়ারায় দুই শতাধিক, চন্দনাইশে শতাধিক, হাটহাজারী উপজেলায় আড়াই শতাধিকসহ চট্টগ্রামের অন্যান্য উপজেলায় সব মিলিয়ে আড়াইহাজার বায়োগ্যাস প্লান্ট আছে। যাতে সব মিলিয়ে ১০-১২ হাজার পরিবার এলপিজি গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এ বায়োগ্যাস ব্যবহার করছেন।
শিকলবাহা এলাকার স্টুডিও বুল অ্যান্ড এগ্রোর স্বত্বাধিকারী মো. আলাউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার গরুর খামারের গোবর ও গোমূত্র প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেছি। এখন আমি নিজেই এ গ্যাস ব্যবহার করি। তাছাড়া আমি অন্তত ৫০টি পরিবারকে আমার প্রতিষ্ঠানের তৈরি গ্যাস সরবরাহ করতে পারব। আমি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা চাহিদা দিলে আমি তাদের মাসিক চার্জের মাধ্যমে সরবরাহ করব। তবে বায়োগ্যাস সরবরাহে প্রাথমিক খরচ অতিরিক্ত হওয়ায় অনেক খামারি প্লান্ট স্থাপন থেকে বিরত থাকছেন।
সাধারণত একটি খামার থেকে ২০টি সংযোগ দিতে হলে সে খামারে ৫০-৬০টি গরু থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পটিতে প্রাথমিকভাবে খরচ পড়বে প্রায় ৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে ৫০টি গ্যাসের লাইন দিতে খামারে গরু থাকতে হবে দেড় শতাধিক। খরচ পড়বে ১০-১১ লাখ টাকা। তবে ছোট পরিসরে ব্যক্তিগতভাবে চার-ছয়টি গরু থাকলে খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। এদিকে বায়োগ্যাসে ব্যবহৃত বর্জ্য পরবর্তী সময়ে জৈব সার হিসেবে বিক্রি করে বাড়তি টাকা আয় করছেন খামারিরা। কৃষিজমিতে এসব জৈব সারের চাহিদাও প্রচুর বলে জানান খামার মালিকরা।
তবে প্রাথমিকভাবে লাইনের জন্য একটু বেশি চার্জ দিতে হয় গ্রাহককে। যেখানে চাহিদা বেশি, সেখানে চার্জ সামান্য বেশি বলে জানান বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনকারী মিস্ত্রিরা। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ও মিস্ত্রিরা জানান, বায়োগ্যাসের লাইন নিতে হলে কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জারটেক, শিকলবাহা এলাকায় গ্রাহককে ৬-৭ হাজার টাকা এবং অন্য উপজেলায় চাহিদা তুলনামূলক কম থাকায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা বায়োগ্যাস প্লান্টের মালিককে দিতে হয়। এছাড়া কর্ণফুলী উপজেলায় এক চুলার জন্য ১ হাজার ৪০০ টাকা ও দুই চুলার জন্য ২ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া অন্য উপজেলায় এক চুলা ১ হাজার ২০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ১ হাজার ৮০০ টাকা বা তার কিছু কম টাকা দিতে হয়।
বায়োগ্যাস প্রযুক্তিবিদ মো. আকতার হোসেন (রুবেল) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের উপজেলা পর্যায়ে গবাদিপশুর খামারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় বায়োগ্যাসের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একটি বড় গরুর খামার তৈরি হলে গোবর ও মলমূত্র সংরক্ষণ করে সেগুলাে সামান্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বায়োগ্যাসে রূপান্তর করা হচ্ছে। সেগুলো মানুষের বাড়িতে এলপিজির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একটি বড় খামারে যদি ১৫০-৩০০ গরু থাকে, তাহলে সেখানে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করলে পাইপলাইনের মাধ্যমে অন্তত ১০০-১৫০ পরিবারের কাছে এ গ্যাস পৌঁছে দেয়া সম্ভব। বায়োগ্যাসের চুলা সাধারণ গ্যাস লাইনের চলার মতো না। এ গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক গ্যাস বা সিলিন্ডার গ্যাসের থেকে অনেক বেশি। তাছাড়া এ গ্যাসে বিস্ফোরণ ঝুঁকি একেবারেই নেই।
বাংলাদেশ বায়োগ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এখলাসুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বায়োগ্যাস প্রকল্পগুলো সাধারণত বাংলাদেশে ব্যক্তিগতভাবে গড়ে উঠেছে। সরকার এখনো এ খাতে সেভাবে নজর দেয়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো খুব ছোট পরিসরে গড়ে উঠছে। যার কারণে খাতটি দেশে লাভজনক হয়ে ওঠেনি। তবে বর্জ্যের রিসাইক্লিংয়ের কারণে যে সার তৈরি হয়, সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আছে। তরল বর্জ্য বহন ও বিপণন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যার কারণে বায়োগ্যাসে ব্যবহৃত বর্জ্য মাটির নিচে রেখে শুকিয়ে পরে তা কাজে লাগানো হয়। কিন্তু এ জৈব সারে এনপিকে নামক পদার্থ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জৈব সার কার্যত কোনো কাজে আসে না। সরকার এ শিল্প খাতে যদি বিনিয়োগ করে তাহলে দেশের বড় একটি অংশ বায়োগ্যাস ব্যবহার ও বাণিজ্যিকীকরণে লাভবান হতো।’