
উন্নয়নশীল বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট (জেপিজি) স্কুল অব পাবলিক হেলথ। জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে গবেষণা এবং টেকসই সমাধান প্রদানের জন্য ব্র্যাক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অর্জন, ব্র্যাক হেলথের দেশব্যাপী সেবা এবং দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের প্রোগ্রাম-জনস্বাস্থ্যে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থায় নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এখানকার মাস্টার অব পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ) ডিগ্রি জনপ্রিয় হয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মাস্টার্স করতে ভিনদেশীরা আসবেন এমন ভাবনা হয়তো খুবই অবান্তর মনে হতে পারে। কিন্তু এ ভাবনা যে শুধু সত্যিই তা নয়, বিশ্বের ৩৫টি দেশের শিক্ষার্থীরা এসেছেন এ ডিগ্রি নিতে।
এ বিষয়ে জানতে গত মঙ্গলবার আমরা হাজির হই ব্র্যাকের জেপিজি স্কুল অব পাবলিক হেলথে। গিয়ে দেখা গেল প্রায় শতাধিক দেশী-বিদেশী গবেষক গবেষণা করছেন। আমরা অপেক্ষা করছি বর্তমান সেশনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ক্লাস শেষ হওয়ার। দুপুর ১টা নাগাদ সবাই যখন একসঙ্গে ফিরলেন মনে হলো যেন শৈশবে দলবেঁধে বন্ধুদের আড্ডার মুহূর্তকে সঙ্গে করে নিয়েই তারা ঘুরছেন। হাসি-আনন্দেই কাটছে তাদের প্রতি মুহূর্ত। মজার ছলে একজন ডাকছেন ‘এই ইয়ামিনি, এই পাকিস্তানি, এদিকে আয়’। বুঝতে বাকি রইল না ভিনদেশী সহপাঠীকে সম্বোধন করেই বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর এই ডাক। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বেরও কমতি নেই।
বর্তমানে চলছে ১৯তম ব্যাচের পাঠদান কার্যক্রম। এ শিক্ষাবর্ষে রয়েছে মোট ২৮ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশী ১৫ জন, বাকি ১৩ জনই ইয়েমেন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, নেপালসহ নয় দেশের শিক্ষার্থী। লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতেও ৫০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় এখানে। বর্তমান সেশনের ২৮ জনের ১৬ জনই নারী শিক্ষার্থী। প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইনসহ ৩৫টি দেশের শিক্ষার্থীরা এমপিএইচ ডিগ্রি নিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে নির্ধারিত আসন। রয়েছে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও। এ পর্যন্ত ৬৩০ দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থী নিয়েছেন এমপিএইচ ডিগ্রি। যারা কাজ করছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্যবিষয়ক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন, বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি, জাইকা, সেভ দ্য চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, ইউএনএফপি, ওয়ার্ল্ড ভিশন, ওয়াটার এইডসহ বিশ্বের নামিদামি সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তারা।
কথা হলো বর্তমান শিক্ষাবর্ষে পড়ছেন এমন কয়েকজন বিদেশী শিক্ষার্থীর সঙ্গে। কেন বাংলাদেশকে বেছে নিলেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জিম্বাবুয়ের চিপো উইনি মুনিইকওয়া জানান, আমার দেশে ছয় বছর চেষ্টার পর ব্র্যাকের পাবলিক হেলথে ভর্তির সুযোগটি যেন আমার কাছে স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দিল। আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্য আমি এ স্কুলের কাছে কৃতজ্ঞ। জনস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং বৃহৎ পরিসরে স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় কাজ করার জন্য আমার আদর্শ পছন্দ ব্র্যাকের এমপিএইচ। অভিজ্ঞ ফ্যাকাল্টিরা ব্যবহারিক দক্ষতার মাধ্যমে আমার শেখার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। ফিল্ডওয়ার্ক, কেস স্টাডি, গবেষণা প্রকল্প এবং মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক শিক্ষার সুযোগগুলো জনস্বাস্থ্যের ধারণা সম্পর্কে আমার ব্যবহারিক দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করেছে। সামগ্রিকভাবে বাস্তব বিশ্বের জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটি একটি অনন্য প্লাটফর্ম।
পাকিস্তান থেকে আসা শাগুফতা বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় নেতৃত্ব তৈরির জন্য ব্র্যাকের এমপিএইচের প্রতিশ্রুতি আমার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঐতিহ্যগত পড়াশোনার বাইরে পরিবর্তনশীল শিক্ষণ পদ্ধতির ওপর গুরুত্বারোপ এ প্রোগ্রামে ভর্তির হতে আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছে।’ চার কারণে এমপিএইচ করার জন্য ব্র্যাক জেপিজিএসপিএইচ বেছে নিয়েছেন আফগানিস্তানের মোখতার আশোর। জানালেন, ‘এখানে রয়েছে বিশ্বমানের শিক্ষা, সামাজিক প্রভাব ফোকাস, অবারিত সুযোগ এবং এই প্রোগ্রামের রয়েছে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি। বহু বছর ধরে একই ধরনের কাজ করা আমার কাছে আনন্দদায়ক মনে হয়নি তাই জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়াশোনা করে আমার কর্মজীবনকে বিভিন্ন উপায়ে বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ পাচ্ছি।’
২০১৩ সাল থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিনের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. সাবিনা ফয়েজ রশীদ। জানালেন, ‘দক্ষতাভিত্তিক একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করতে তিনি কাজ করেছেন যেটি মাঠ পর্যায়ে প্রায়োগিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করে। গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় জনগোষ্ঠীর জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিদ্যমান ও উদীয়মান নানা বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা।’
এমপিএইচে ভর্তির জন্য শুধুই এমবিবিএস ডিগ্রিধারীরাই নন আপনার যদি লাইফ সায়েন্স, মেডিসিন, নার্সিং, পাবলিক হেলথ, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান বিষয়েও স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকে তাহলে আপনি সহজেই আবেদন করতে পারবেন। ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হলে ফুল ফ্রি স্কলারশিপ নিয়ে পড়ারও সুযোগ রয়েছে। এমপিএইচ প্রোগ্রামের জন্য দেয়া হয় চারটি স্কলারশিপ। সেগুলো হলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ‘ট্রেইনিং ইন ট্রপিক্যাল ডিজেসেস’(টিডিআর) স্কলারশিপ, বাংলাদেশী ও আন্তর্জাতিক উভয় শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি স্কলারশিপ’, শুধু বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ স্কলারশিপ’ এবং আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশী নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আমিনা আজফার অ্যান্ড হুরমাতুননেসা রব স্কলারশিপ’। আগামী ১৭ জুন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে বেলা ২টা-৫টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে ‘ক্রিয়েটিং দ্য নেক্সট জেনারেশন অব পাবলিক হেলথ লিডারস’ ইভেন্ট। যেখানে গ্লোবাল ফ্যাকাল্টি, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। রেজিস্ট্রেশন করে ইভেন্টে অংশ নিয়ে জেনে নিতে পারেন এমপিএইচে ভর্তির আদ্যোপান্ত।