পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে ফিরছে বলে সিপিডির আশঙ্কা

গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে দেখা হোক

সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এতে পাচার হওয়া অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আনা হচ্ছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। শ্রমবাজার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি জনবল গেলেও এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স আসছে বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করে তার তদন্ত করার আহ্বানও জানিয়েছে সিপিডি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির খবর বাংলাদেশের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। তবে বিশেষত টাকার অবমূল্যায়ন, প্রণোদনা প্রদানের মতো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটি বেড়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অবৈধ পথে অর্জিত এবং পাচারকৃত অর্থ রেমিট্যান্স আকারে ফেরত আসা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে সিপিডি। প্রত্যাশা থাকবে, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেবে। 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না বরং বিষয়টি আরো উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বাদ সাধছে অর্থ পাচারের বিষয়টি। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জিত আয় পাচারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ এবং রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সেটি দেশে পুনরায় বৈধ হয়ে প্রবেশ করলে তা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। এতে সরকারের লোকসানের পাশাপাশি প্রকৃত রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। এক্ষেত্রে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়াটাই কাম্য। আবার এ কথাও সত্য, গত বছরের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেশি বেড়েছে বলেও দাবি করা যাবে না। কারো অ্যাকাউন্টে বড় ধরনের রেমিট্যান্স আসছে কিনা তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আসা অর্থ পাচারের টাকা কিনা তা যাচাই করতে গিয়ে কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। এতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যেতে পারে, যা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে কমে আসায় দেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়ে ওঠা এক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ। এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আরো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। 

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, আগের চেয়ে বেশকিছু শর্ত শিথিল করায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে অর্থ পাঠানো সহজ হয়েছে। এছাড়া বৈধ পথে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। ডলারের রেটও বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশীদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা পেশাগতভাবে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছেন। এসব কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা। এতে রেমিট্যান্সের উৎস হিসেবে এখন প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকার মহামারীর ফলে চাকরি হারানো ব্যক্তিদের বিশেষ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, যা রেমিট্যান্সপ্রবাহকে বাড়িয়ে তুলেছে। কারণ প্রবাসীদের আয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় বেশি ছিল। অফিশিয়াল ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর প্রাধান্য এবং বৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের সরলতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিদেশী নাগরিকদের তাদের আয় দেশে প্রেরণে উৎসাহিত করেছে, যা সামগ্রিক রেমিট্যান্সপ্রবাহের জন্য ভালো। উপরন্তু হুন্ডি পদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় না। সৌদি আরব থেকে আসা সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের জায়গাটি দখল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশের রেমিট্যান্সে এটি নতুন একটি ধারা। নব্যসৃষ্ট এ ধারার কারণ হতে পারে, যেখান থেকে অর্থ পাচার হয়ে গেছে সেখানেই তা ফেরত আসছে। 

অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বোঝা। এটি প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন ভেস্তে যাবে। জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ পাচারের মাধ্যমে বেরিয়ে যাচ্ছে। দেশের এক শ্রেণীর সরকারি আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের মধ্যে নৈতিকতা ও দেশপ্রেম বলতে কিছুই নেই। সেজন্য তারা অবৈধ অর্থ, ব্যাংকের টাকা, জনগণের আমানত, দেশের সম্পদ ইত্যাদি আত্মসাৎ ও লুট করে নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও জনগণকে এদের বিরুদ্ধে সতর্ক হতে হবে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও আসন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য প্রধানমন্ত্রী নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। পুঁজি পাচার প্রতিরোধকে বর্তমানে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে রফতানিকারকদের বিদেশে রফতানি আয় রেখে দেয়ার পরিমাণ সীমিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয় দেশে আনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর যৌথভাবে কমিটি গঠন করে দ্রব্যের আমদানি ও রফতানি মূল্য যাচাই করে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও সিআইডিকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের যুক্তিতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করা অর্থ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আকারে ফেরত আনার ঢালাও সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এক্ষেত্রে পাচারকারীরাও প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের মতোই আড়াই ভাগ হারে প্রণোদনা পাবেন। একই সঙ্গে পাচার করা অর্থ ফেরাতে আসছে বাজেটে অর্থমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন স্বল্প জরিমানা দিয়ে বিদেশে অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ঘোষণা বা ‘ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’ দেয়ার। এ ধরনের সুযোগ প্রদান শুধু অনৈতিক ও সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতই নয়, অসাংবিধানিকও বটে। অন্যদিকে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বাস্তবে তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গর্হিত এ অপরাধের জন্য শাস্তির বদলে পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করার এসব উদ্যোগ অর্থ পাচারকারী তথা দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার শামিল। 

অর্থ পাচারের মামলায় অভিযুক্তরাও এ সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলে তাদের কি কোনো শাস্তি ভোগ করতে হবে না? এক্ষেত্রে সরকার কি তবে আইনের শাসনের পথ ফেলে আপসের পথে হাঁটবে? এসব বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা জরুরি। বাজেটে বার-বার কালো টাকা সাদা করার অন্যায্য, অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতি সহায়ক সুযোগ দেয়া হলেও তাতে রাষ্ট্রের কোনো উল্লেখযোগ্য সুফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার বিব্রতকর উদাহরণের পরও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর নামে এ ধরনের অনৈতিকতার মহোৎসব কোনো বাস্তব ফল বয়ে আনবে মনে করাটা অযৌক্তিক এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এতে পাচারকারীরা অর্থ পাচারে বরং আরো উৎসাহিত হবে, অর্থ পাচার আরো গভীর ও বিস্তৃত হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেই ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তার উল্লেখ করে নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থ পাচারের এ তথ্য সরকারের অজানা নয়। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা, দায়িত্বে অবহেলা, সৎসাহসের ঘাটতি, এমনকি যোগসাজশের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে পাচার হওয়া অর্থ যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, সরকারি উদ্যোগে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা তার বড় প্রমাণ। দুর্নীতি দমন কমিশনের পাশাপাশি অর্থ পাচার প্রতিরোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যৌথভাবে অর্থ পাচারের গন্তব্য দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহায়তা উদ্যোগের মাধ্যমে পাচারকারীদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে পাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা অর্জনে ব্যর্থতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

আইন প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট ও পরীক্ষিত পথ পরিহার করে অর্থ পাচারকারীদের অনৈতিক সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না। এতদিনে এটি স্পষ্ট যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পেশাগত উৎকর্ষ ও সৎসাহসের পাশাপাশি সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়। অর্থ পাচার রোধে তাই দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের যে তথ্য জিএফআইয়ের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশ করে, সেটি আংশিক। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের তথ্য দেয়। বাস্তবে এ অপরাধের প্রক্রিয়া ও গভীরতা আরো অনেক বেশি। তাই অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা এবং এ অপরাধে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অন্যতম রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য। এজন্য সরকারের উচিত, অর্থ পাচারকারীদের জন্য অভিনব সুযোগ বা সুরক্ষা প্রদানের পথ পরিহার করে অবিলম্বে অর্থ পাচারকারীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং পাচার হওয়া অর্থ আইনি ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরত আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন