মহামারী ও যুদ্ধের আঘাতে বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাত প্রভাবিত। ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে খাদ্য ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি। করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের কারণে হঠাত্ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০২১ সালের শেষভাগ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে এ মূল্য পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। গত এক বছরে তেমন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হতে না হতেই আগামী ১ জুন প্রস্তাব উঠবে নতুন অর্থবছরের বাজেটের। উদ্যোক্তারা বলছেন, চলমান ২০২২-২৩ অর্থবছরটি তাদের জন্য স্বস্তির ছিল না।
বিশ্বে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কর আর কোনো দেশের ব্যাংক থেকে আদায় করা হয় না বলে দাবি করছেন ব্যাংক মালিকরা। তারা বলছেন, দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করহার কিছুটা কমিয়েছে। তার পরও এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। করপোরেট কর না কমালে অনেক ব্যাংকই নিট মুনাফায় থাকতে পারবে না। এজন্য ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবিটি এবার আরো বেশি জোরালো হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রফতানিমুখী শ্রমঘন পোশাক শিল্পের প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকারে রয়েছে উেস করহার হ্রাসের বিষয়টি। তারা বলছেন, রফতানির বিপরীতে প্রযোজ্য উেস কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে আগের মতো শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত কার্যকর করা। এটি করা হলে উদ্যোক্তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মধ্যমেয়াদি ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা করতে পারবেন।
পোশাক শিল্পের পক্ষ থেকে রিসাইক্লিং শিল্পের দিকে বিশেষ নজর প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তারা বলছেন, শিল্পসংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া, পণ্য ও সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হলে বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আকৃষ্ট হবেন। স্থানীয় পর্যায়ে স্থাপিত রিসাইকেল ফাইবার উত্পাদনকারী মিলে ব্যবহূত কাঁচামাল সংগ্রহ ও পরবর্তী সময়ে উত্পাদিত রিসাইকেল ফাইবার মিল কর্তৃক স্থানীয় স্পিনিং মিলে তা সরবরাহের ওপর ধার্যকৃত যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫ ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।
এভিয়েশন খাতের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এয়ারক্রাফট ও এয়ারক্রাফটের যন্ত্রাংশের ওপর কোনো এক সময় কোনো ট্যাক্স ধার্য ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ধাপে ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে। যেমন এয়ারক্রাফট আমদানির ওপর বর্তমানে ৫ শতাংশ এটি (অ্যাডভান্স ট্যাক্স) ধরা হয়েছে। এ কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাওয়া হয়েছে। এয়ারক্রাফটের আট ক্যাটাগরির যন্ত্রাংশের ওপর কোনো ট্যাক্স ছিল না। এ আট ক্যাটাগরির বাইরের যন্ত্রাংশগুলোয় বিভিন্ন ধাপে ট্যাক্স ধার্য ছিল। সব ক্যাটাগরির যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রেই শূন্য ট্যাক্স ধার্য করার দাবি রয়েছে। বর্তমানে ৫ শতাংশ ‘এটি’
ও ৫ শতাংশ ‘এআইটি’
আছে। তার মানে ১০ শতাংশ। আর আট ক্যাটাগরির বাইরে থাকলে তার সঙ্গে আরো কিছু যুক্ত হয়। সেক্ষেত্রে আলাদা ট্যাক্স কোড আছে। সে কোড অনুযায়ী দেখা যায়, কোনোটা ৩৬ শতাংশ, কোনোটা ৪৬, কোনোটা ৫০, কোনোটা ৭৫ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে এয়ারক্রাফট ও এয়ারক্রাফটের যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে শূন্য ট্যাক্স নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়েছে।
আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষিনির্ভর হওয়ার পথে বাংলাদেশ কৃষিযন্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর। খাতসংশ্লিষ্টরা ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন। এ যন্ত্র বিক্রির ওপরও ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ৫ শতাংশ কর যুক্ত হলে যন্ত্রাংশগুলোর দাম অনেক বেড়ে যায়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে কর প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের দাবি, আগের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। তবে এখনো ১০ লাখের বেশি মানুষ দেশের বাইরে চিকিত্সার জন্য যায়। বিষয়টি বিবেচনার প্রতিফলন তারা বাজেটে দেখতে চায়। চিকিত্সা যন্ত্রাংশের ওপর ৫ শতাংশ কর রয়েছে। আরো ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর রয়েছে। এরপর স্পেয়ার পার্টসগুলোর (খুচরা যন্ত্রাংশ) ওপর ৩৫ শতাংশ আসে। জীবনরক্ষাকারী যেমন ব্লাড ব্যাংক, ওটি লাইট, ওটি টেবিল এসবের ওপর ১৫-৩৫ শতাংশ কর আসে। একটা কর রেখে অগ্রিম আয়করকে বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাদের খাতে ভ্যাট, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। এখানে ভ্যাট ৫ শতাংশ রাখার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্য অঞ্চলগুলোয় ট্যাক্সের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য একটা নীতিমালা চাওয়া হয়েছে সরকারের কাছে।
নির্মাণ খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন স্ক্র্যাপ আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর কমানোর কথা। তারা বলছেন, রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আমদানিতে টনপ্রতি শুল্ক ১ হাজার ৫০০ থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে তারা প্রতি টনে অগ্রিম কর ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা কাটার দাবি জানিয়েছে। সিমেন্ট খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্লিংকার আমদানিতে টনপ্রতি শুল্কের পরিমাণ ৫০০ থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করা প্রয়োজন। সিমেন্ট উত্পাদনের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার, স্ল্যাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম আমদানিতে বর্তমানে যে ৩-৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। সেটি কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাবও রেখেছে সংগঠনটি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ বিদেশ থেকে তাদের অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারবেন, এমন একটা সুযোগ রাখা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হয়নি জানিয়ে আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, আবাসন খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৫-১০ বছরের জন্য গৃহায়ণ খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ ফ্ল্যাট, প্লট, বাণিজ্যিক ভবন ও বিপণিবিতান এ বিনিয়োগের জন্য বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা বহাল রাখা প্রয়োজন। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বাজেট সামনে রেখে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে ঘিরে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ও ভাবনা নিয়ে এ আয়োজন।
