যশোরে কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন কলেরায় আক্রান্ত রোগীরা। চার মাস ধরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছেন রোগীরা। এতে তিন জন রোগী মারাও গেছেন। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে দাবি করেছেন জেলা সিভিল সার্জন। এ অবস্থায় জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, চার মাস আগে জেলায় কলেরার প্রকোপ দেখা দেয়। মার্চের শুরুর দিকে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা । এ অবস্থার কারণ নির্ণয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) শরণাপন্ন হয় জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। গত ৩১ মার্চ আইইডিসিআরের টিম যশোরে এসে কারণ অনুসন্ধান শুরু করে। টিমটি দুই সপ্তাহ ধরে রোগী, তাদের স্বজন, রোগীসংশ্লিষ্ট সদর ও চৌগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পানিসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে। তাদের অনুসন্ধানে পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি, ব্যক্তিগতভাবে বসানো সাবমারসিবল পাম্পের পানিতে কলেরার জীবাণু মেলে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তথ্যমতে, বর্তমানে যারা ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই কলেরায় আক্রান্ত। প্রতিদিন ৫০-এর বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এরই মধ্যে ছয়টি শয্যার বিপরীতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। তাদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকরা।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের সংক্রামক ওয়ার্ডে শহরতলীর ঝুমঝুমপুর এলাকার আব্দুর রহমানের মেয়ে তিনদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মেয়ের বারবার পায়খানা হচ্ছিল, সঙ্গে বমি। তবে হাসপাতালে ভর্তির পর এখন বেশ ভালো আছে। চিকিৎসক বলেছেন, আজ অথবা কালকের মধ্যে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব।’
কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হঠাৎ ডায়রিয়া শুরু হয়। সঙ্গে দফায় দফায় বমি। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হন।
চার মাস ধরে হাসপাতালে ডায়রিয়া ও কলেরার রোগী আসছেন বলে জানান হাসপাতালের সংক্রামক ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স শারমিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘রোগীর প্রচুর চাপ। রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। রোগীর সঙ্গে অনেকে আসছেন। তারা সঙ্গে থাকেন, একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন। পরে তারাও আক্রান্ত হন। তাদের বুঝিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।’
চার মাস ধরে আমরা এসব রোগী নিয়ে ভুগছি উল্লেখ করে যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, ‘প্রথমদিকে শহরের কয়েকটি এলাকার রোগী ছিল। এখন বিভিন্ন উপজেলা থেকে রোগী আসছে।’
হাসপাতালে সংক্রামক রোগীর জন্য ছয়টি বেড আছে। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত রোগী ভর্তি রয়েছে ১১৫ জন। রোগীদের মধ্যে নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে।গত রমজানে আইইডিসিআরের প্রতিনিধি দল এসেছিল। তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে কলেরার জীবাণুর কথা উঠে এসেছে। কলেরা রোগীদের যে যে উপসর্গ থাকে, হাসপাতালে যেসব রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন; তাদের অনেকের সেসব উপসর্গ আছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের দেয়া প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা চলছে।’
এ অবস্থায় জনসচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুস সাদিক। তিনি বলেন, ‘আসলে কী কারণে এ রোগে এত বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগের শরীরে পানিশূন্যতা রয়েছে। এ কারণে তাদের রেনাল ফেইলুর বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। ধারণা করছি, পানিবাহিত কারণে আক্রান্ত বেশি হচ্ছেন তারা।’
অল্প অসুস্থতায় হাসপাতালে না আসার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া ভালো হবে। কেননা হাসপাতালে এটি একজনের থেকে অপরজনের মধ্যে ছড়াতে পারে।’
খাবার স্যালাইন ও ডাবের পানি বেশি বেশি পানের পরামর্শ দিয়ে নাজমুস সাদিক বলেন, ‘যাদের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা কার্ডিয়াক সমস্যা রয়েছে, তাদের পরিস্থিতি এমন হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হবে।’
জেলায় ডায়রিয়া ও কলেরা রোগীর সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘কিছুদিন ধরে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগী বাড়ার কারণে আমরা আইইডিসিআরকে পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলাম। তাদের টিম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের জানিয়েছে, পানি থেকে এ রোগ ছড়াচ্ছে। তাদের এ রিপোর্টের বিষয়টি আমরা জেলা প্রশাসক ও পৌরসভাকে জানিয়েছি। পৌরসভা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের পাইপ পরীক্ষা শুরু করেছে এবং লিকেজগুলো মেরামত করছে।’
যেহেতু রোগী বাড়ছে সেহেতু আমাদের প্রস্তুতি আছে জানিয়ে ডা. বিপ্লব কান্তি বলেন, ‘আমাদের আওতার বাইরে এখনও যায়নি। ওষুধ, স্যালাইন সবকিছু পর্যাপ্ত আছে। এরই মধ্যে হাসপাতালে রোগীদের জন্য আমরা একটি ওয়ার্ড খুলেছি।’