ব্যবসা সহজীকরণ ও বৈশ্বিক সংকট উত্তরণের সহায়ক বাজেট চাই

সহজ  ব্যবসাবান্ধব আয়কর ব্যবস্থা, আয়কর মূল্য সংযোজন করের আওতা বাড়ানো, কর ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অটোমেশন, রফতানি বহুমুখীকরণ স্থানীয় শিল্পায়ন উৎসাহিতকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণের ওপর আমরা জোর দিয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য ৩৩টি প্রস্তাব দিয়েছি। এসব প্রস্তাব সরকারের রাজস্ব বাড়ানো ব্যবসা সহজীকরণে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।

মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে কর মওকুফ সীমা বাড়ানো প্রয়োজন। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান সুরক্ষা পাবে। লাখ টাকা পর্যন্ত কর অব্যাহতি সীমা নির্ধারণ করলে নিম্ন আয়ের মানুষের  ওপর করের প্রভাব হ্রাস পাবে। অন্যদিকে মধ্যম উচ্চ আয়ের মানুষের ওপর করের প্রভাব যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি শ্রেণী থেকে প্রাপ্ত কর রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। এতে সামগ্রিক রাজস্ব পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। সার্বিক বিবেচনায় প্রত্যেক ব্যক্তি করদাতার জন্য প্রথম লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর করহার শূন্য, পরবর্তী লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শতাংশ, পরবর্তী লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, পরবর্তী লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ করা উচিত মনে করে আমাদের প্রস্তাব রেখেছি।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কর রাজস্বের পরিমাণ দশমিক শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। বর্তমানে মাত্র ২৮-৩০ লাখ করদাতা তাদের রিটার্ন জমা দেন, যা জনসংখ্যার মাত্র শতাংশ। কর রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে আগামী ১০ বছরে করদাতার সংখ্যা কোটিতে নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাছাড়া অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ৪৮ শতাংশ ঢাকা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। কিন্তু ৯০ শতাংশ রাজস্ব দুই অঞ্চল থেকে আসায় রাজস্ব আহরণের চাপও অঞ্চলগুলোয়ই বেশি। করজাল বাড়াতে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। করজাল বাড়ানোর ক্ষেত্রে শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে করদাতাদের কিছু ছাড় বা রেয়াত দেয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।

বর্তমানে লিস্টেড নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট করহার যথাক্রমে ২০ ২৭ দশমিক শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট করহার দশমিক শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছি। লিস্টেড নন-লিস্টেড কোম্পানির করহারের ব্যবধান কমানো স্থানীয় ব্যবসাকে উৎসাহিত করার জন্য নন-লিস্টেড কোম্পানির করপোরেট কর আরো কমানো প্রয়োজন, যাতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকালে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারে এবং বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ অঞ্চলে অন্যতম প্রতিযোগী সক্ষম দেশ হিসেবে সমাদৃত হয়। এতে জিডিপিতে বিনিয়োগের অবদান বাড়বে। এছাড়া লিস্টেড নন-লিস্টেড উভয় ধরনের কোম্পানির ক্ষেত্রে ক্যাশ লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা ৩৬ লাখ টাকার পরিবর্তে বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছি। কারণ ক্যাশ লেনদেনের নির্ধারিত সীমা কোম্পানির ব্যবসায়িক লেনদেনের পরিমাণের তুলনায় অনেকটা কম যথাযথ নয়, কাজেই সীমা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

উৎসে করকে আবার ৮২সি ধারায় নিয়ে হিসাব করা হলে দ্বৈত কর আরোপের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এছাড়া ৮২সি (ডি) অনুযায়ী কোনো করদাতা উৎসে কর দেয়ার পর তার করের চূড়ান্ত হিসাবে যদি কম হয়ে থাকে, তাহলে যে পরিমাণ কম দিয়েছেন, তার সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনো করদাতা উৎসে বেশি পরিমাণ কর দিয়ে থাকলে তা সমন্বয় করার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়কে উভয়মুখী করার প্রস্তাব করেছি, যাতে করদাতা বেশি পরিমাণে উৎসে কর প্রদান করে থাকলে তা সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়। তাহলে করদাতাদের অতিরিক্ত করের বোঝা অনেকটা হলেও কমবে। কোম্পানির ক্ষেত্রে অর্জিত ব্যাংক সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছি। এভাবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হারে উৎসে কর কর্তনের ফলে কটেজ, ক্ষুদ্র বা ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাংকে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হবেন। উৎসে করের হার কমানো হলে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট দূরীকরণে এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সঞ্চয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

ইন্টিগ্রেটেড ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম (আইটিএএস), ইন্টিগ্রেটেড ভ্যাট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সিস্টেম (আইভিএএস) কাস্টমস তিন ক্ষেত্রে অটোমেশনকে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেছি। ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শতভাগ অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে করদাতারা অটোমেটেড পদ্ধতিতে করজালের আওতায় চলে আসবেন এবং সরকারের রাজস্বও অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি হবে। এছাড়া কাস্টমস ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের লক্ষ্যে অতি দ্রুত বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইনডোকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব করেছি। ভ্যাটের আওতাবহির্ভূত ব্যবসায়ীদের টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা কোটি টাকা টার্নওভার কর শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা কোটি টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করছি এবং পণ্যের ভ্যালু অ্যাডিশন অনুপাতে বা মুনাফা অনুপাতে টার্নওভার ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব করছি। ব্যর্থতা, অনিয়ম বা কর ফাঁকির ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপকে যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের প্রস্তাব করেছি। বিদ্যমান আইনের ধারা পরিপালনে যে ধরনের অনিয়মের বিপরীতে জরিমানার বিধান করা হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়নি। কারণে ভ্যাট এসডি অ্যাক্ট, ২০১২- বর্ণিত জরিমানাকে যৌক্তিকীকরণ করা হলে গুরুত্বানুসারে জরিমানা আরোপের ফলে কার্যকরভাবে আইন প্রতিপালন সহজ হবে।

ভ্যাট এসডি অ্যাক্ট, ২০১২ ধারা ৬৮-এর অধীনে ঋণাত্মক নিট অর্থ জের টানার পরে যা ফেরতযোগ্য হয়, তা এক মাসের মধ্যে ফেরত দেয়ার প্রস্তাব করেছি। ধারায় ৫০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে ফেরত প্রাপ্তি থাকলে ছয় মাস জের টানার পরে আবেদন দাখিলের মাধ্যমে বকেয়া করের দায়-দেনা (সুদ, দণ্ড, জরিমানাসহ) কেটে নেয়ার পর তিন মাস সময়ের মধ্যে ফেরত দেয়া হয়। প্রায় নয় মাস ব্যবসায়ীদের কার্যকর মূলধন আটকে থাকার ফলে ক্ষুদ্র ছোট ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে কারণে ফেরতপ্রাপ্তির সময় কমিয়ে আনা ফেরতযোগ্য অর্থ পরবর্তী কর মেয়াদ বা এক মাসের মধ্যে ফেরত প্রদান করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি।

এছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা উৎপাদন সক্ষমতা বজায় রাখতে স্থিতিশীল অনুমানযোগ্য জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ, গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে অনশোর অফশোর ব্লকে গ্যাস উত্তোলন জোরদার করা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিভিন্ন প্রাথমিক জ্বালানির উৎস যেমন: কয়লা, গ্যাস, লিকুইড ফুয়েলের সরবরাহ বিকল্প বিভিন্ন আমদানি উৎস থেকে নিশ্চিত করার বিষয়েও আমরা জোরালো আহ্বান রেখেছি।

শিল্প বিনিয়োগের উন্নয়নে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বিনিয়োগবান্ধব করার জন্য সেখানে সব ইউটিলিটি সার্ভিস সংযোগ সড়ক দ্রুততার সঙ্গে নির্মাণ করে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণের প্রস্তাব রেখেছি। কৃষির আধুনিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা, শিল্পে কাঁচামালের সরবরাহ এসএমইর বিকাশে উন্নয়ন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো এবং কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা কৃষি স্টার্টআপ ফান্ড গঠন করার বিষয়ও আমরা প্রস্তাব করেছি।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ভ্যালু চেইন প্রক্রিয়ায় সব ধরনের পরিবেশগত, সামাজিক বাণিজ্য প্রশাসনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে বাজেট সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি। এছাড়া বিশ্বের সার্বিক মন্দা অবস্থা থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন, সে উপায়গুলো যৌক্তিকভাবে আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব উত্তরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন