আমদানি এবং বিক্রয় পর্যায়ে অগ্রিম কর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা দরকার

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম , নির্বাহী পরিচালক, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (সিমেন্ট, কয়লা এগ্রিগেটস)

 দেশে বর্তমানে ৩৪টি সিমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে উৎপাদন হয় ৪০ মিলিয়ন টনের কিছু কম। অর্ধেকের বেশি সক্ষমতাই অব্যবহূত থেকে যায় প্রতি বছর। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

৩৪টি সিমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশে আছে। এটি ২০২২ সালের তথ্য। উৎপাদনক্ষমতা ৮০ মিলিয়ন টন, এটাকে ইফেক্টিভ প্রডাকশন ক্যাপাসিটি (তাত্ক্ষণিক উৎপাদন সক্ষমতা) বলি আমরা। যেখানে বিক্রি ছিল ৪০ মিলিয়ন টনের কম। যেটা আমরা বলতে পারি ইউটিলাইজেশন ৪৮ থেকে ৪৯ শতাংশ। এটা অবশ্যই একটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেছেন বলেই তো উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদা যদি উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে অর্ধেক কম হয়, তাহলে তার ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন হবে না। এটা না হলে ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। যেটা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি, গত বছর যে ৩৪টা কোম্পানি উৎপাদনে ছিল, সেখান থেকে নয়টা কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সংখ্যা আরো কমতে থাকবে। এতে করে খাতে যারা বিনিয়োগ করেছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক খাতে মূলধন জোগান দিয়েছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর চলতি মূলধনের ঘাটতির কথা শোনা যায়। বিষয়টি সম্পর্কে একটু বলুন।

চলতি মূলধন ঘাটতি হয় কেন? যখন একটা কোম্পানি অপারেশনে থাকে, কোম্পানি উৎপাদন করে, বিপণন করে, বিক্রি করে তখন লেনদেন হয়। এতে যদি কোম্পানির লাভ হয় তাহলে তো মূলধন ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। এতেই বোঝা যাচ্ছে চলতি মূলধনের যে ঘাটতি আপনারা শুনছেন তা অনেকটাই সত্যি। ধরনের ঘাটতি হলে একটাই উত্তর পরবর্তী উৎপাদন চলমান রাখার মতো মূলধন তার থাকবে না। যেটার ফলস্বরূপ উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। এটা হয়তো কাঁচামাল সংকটের কারণে অথবা মূলধন ঘাটতির কারণেযেকোনো কারণেই হতে পারে। কারণ খাতে সব কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। এখন কাঁচামাল সংকটের কারণ হতে পারে মূলধন না থাকা অথবা ডলার সংকটের কারণে সে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না।

বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে আপনাদের কাঁচামাল আমদানিতে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে কি?

আমদানি সচল রাখার জন্য ডলারের স্বাভাবিক জোগান আবশ্যক। ডলারের জোগান দেয়া তো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আমদানি সবাই করতে পারছে না। অনেক কোম্পানি আমদানি নিয়মিত করতে পারছে না দেখে উৎপাদনও নিয়মিত করতে পারছে না। ফলে তারা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে না পারার কারণে বাজারে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামের কারণে সব পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। নির্মাণ সামগ্রীর ইন্ডাস্ট্রিতে এটা বেশ বেড়েছে। শুধু সিমেন্ট না, আমদানিনির্ভর সবকিছুর দামই বেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে।

বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের বাজারে সিমেন্টের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের রফতানির সুযোগ বিবেচনায় আমাদের দেশে অনেক বেশি সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। আপনার কী মনে হয়?

অবশ্যই বেশি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে বললেও ভুল হবে। আসলে ২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশে ৭২টি সিমেন্ট কোম্পানি ছিল। এটি কমতে কমতে এখন ৩৪টিতে এসেছে। যারা বড় হচ্ছে তারা কিন্তু আরো বড় হচ্ছে। আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু কোম্পানির সংখ্যা কিন্তু কমেছে। বছরও দেখা যাচ্ছে আট-নয়টি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। যারা বন্ধ হচ্ছে তারা ছোট কোম্পানি। দেখা যাচ্ছে নয়টা কোম্পানির সক্ষমতার সমান সক্ষমতা নিয়ে একটা কোম্পানি বাজারে চলে আসছে। ফলে উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু কোম্পানির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সক্ষমতাটা অবশ্যই অপরিকল্পিত। সবাই ভাবছে যে চাহিদা বাড়বে তাই সক্ষমতা তৈরি করে রেখেছে। কারণ বাংলাদেশ সিমেন্ট কনজাম্পশনে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এটি আগামীতে বাড়বে। তবে এটাও মানতে হবে, চাহিদা বাড়ার যে রেশিও তার সঙ্গে সক্ষমতা বাড়ার রেশিওটা এক না। যখন সক্ষমতার ৮০ শতাংশ উৎপাদন এবং বিক্রি করা সম্ভব হবে তখন নতুন করে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে চাহিদা বিবেচনায় সক্ষমতার গড়ে ৫০ ভাগ উৎপাদন করতে পারছে। তার পরও সক্ষমতা বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। এটাকে আমি বলব অনিয়ন্ত্রিত। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার এটার ওপর চিন্তাভাবনা করা উচিত।

দেশীয় কোম্পানিগুলোর যেহেতু উৎপাদন সক্ষমতা আছে, তাহলে সেটি কাজে লাগিয়ে সিমেন্ট রফতানিতে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ কতটুকু?

সিমেন্ট একটি লজিস্টিকবেইজ ব্যবসা। কাঁচামাল আমার দেশের না। বিদেশ থেকে আমদানি করে নিয়ে আসছি। এখন আমি রফতানির জন্য যাব কোন দেশে? সেখানে তো কাঁচামালই আছে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বিবেচনায় তো বাজারে টিকবে না। ধরুন আমি ক্লিঙ্কার (সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল) আমদানি করি দুবাই থেকে। আমার তো দুবাইতে রফতানি করা সম্ভব না। পাশের দেশ ভারতেও কাঁচামাল আছে। এখন ভারতের কয়েকটি রাজ্যে সে দেশে উৎপাদিত সিমেন্ট আসতে খরচ একটু বেশি লাগার কারণে আমাদের এখান থেকে অল্প কিছু রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে। আমরা এখান থেকে ভিয়েতনাম যেতে পারব না কারণ আমরা সেখান থেকে কাঁচামাল আমদানি করছি। সিমেন্টটা হচ্ছে লজিস্টিক এবং উৎপাদন ব্যয়নির্ভর একটি ব্যবসা। সুতরাং এখানে রফতানি সম্প্রসারণের কোনো সম্ভাবনা নেই।

এবারের বাজেটে আপনারা খাতে কী ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন?

সরকারের কাছে আমরা এরই মধ্যে কিছু দাবি পেশ করেছি। আমরা কর প্রক্রিয়াটাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন করার কথা বলেছি। যেন আমাদের দেশের উৎপাদন ঠিক থাকে এবং বাজারমূল্য ঠিক রাখতে পারি। কারণ বিশ্বব্যাপী সব জিনিসেরই যখন মূল্য বেড়ে গেছে, তার একটা প্রভাব আমাদের এখানেও এসে পড়েছে।

বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসের চাহিদা কিন্তু কমেছে। গত বছর এবং চলতি বছর। আমাদের বিক্রয় পর্যায়ে যে অগ্রিম আয়কর নেয়া হয়, সেটি শতাংশ ধার্য করা হয়েছে। আমরা বাজেটে সরকারের কাছে দাবি করেছি আমদানি এবং বিক্রয় পর্যায়ে অগ্রিম কর শূন্য দশমিক শতাংশ করার জন্য। পরবর্তী সময়ে যার যার কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে এটাকে যেন সমন্বয় করে নেয়া হয়।

তাছাড়া আমরা অগ্রিম আয়করের চূড়ান্ত দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বর্তমান আয়কর আইনের সেকশন-৮২-সি(), (বি) (ii) অব ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স ১৯৮৪ সিমেন্ট শিল্পের জন্য অপ্রযোজ্য বিবেচনা করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা ক্লিংকারের ডিউটি প্রতি টন ৫০০ টাকা করে যে নেয়া হয়, সেটি ২০০ টাকা করে ধার্য করার দাবি জানিয়েছি। তাছাড়া আমরা সিমেন্ট শিল্পে কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্যারিফ পদ্ধতি চালু করার কথা বলেছি। এটা স্টিলে কিন্তু চালু আছে। সিমেন্টে একেক কোম্পানির জন্য একেক ধরনের মূল্যের ওপর কর ধার্য করা হয়। আমরা বলেছি সবার জন্য একই করে দেন, তাহলে প্রতিযোগিতাটা ঠিক থাকবে। ট্যারিফ পদ্ধতি চালু করলে কর নিয়ে মতপার্থক্যও দূর হবে। অগ্রিম কর আমদানি পর্য়ায়ে যে পাঁচটি উপাদান আছে, ক্লিংকার, স্লাগ, লাইমস্টোন, ফলাই অ্যাশ জিপসামের ওপর শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য করা হচ্ছে, সেখানে শতাংশ করার অনুরোধ করেছি। আমরা ডিউটি ড্র ব্যাক প্রক্রিয়া সহজ করে আগের মতো দাখিলপত্র মূসক .- সমন্বয় করার অনুরোধ করেছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন