সিমেন্ট শিল্পকে রুগ্ণ করে বেশিদূর এগোনো যাবে না

জহির উদ্দিন আহমদ , ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড

কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায় সিমেন্টসহ নির্মাণ খাতের সব উপকরণেরই দাম বাড়ায় ব্যক্তি পর্যায়ে ভবন নির্মাণে এমনিতে একটা চাপ তৈরি হয়েছে। নতুন বাড়ি নির্মাণ, ফ্ল্যাট কেনার জন্য প্রদত্ত ঋণের ওপর বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সুদহার কতটা যৌক্তিক পর্যায়ে আছে বলে মনে করছেন?

বাড়ি করতে গেলে সর্বোচ্চ ১৫ বছর মেয়াদে একটি ঋণ দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ঋণের কিস্তিটা অনেক বড় থাকে। এটি ঋণগ্রহীতার ওপর অনেক চাপ তৈরি করে। ক্রেতার জন্য খুব বেশি বিনিয়োগ উপযোগী হয় না। এ ঋণকে যদি একটু দীর্ঘমেয়াদি করা যায়, উদাহরণস্বরূপ ৩০ বছর মেয়াদি করা যায়, তাহলে সুদহার অনুযায়ী কিস্তিটা অনেক সফট হয়। তাহলে বিনিয়োগের পরিমাণ কিন্তু অনেক বাড়বে। বাংলাদেশে একটি যৌক্তিক ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। আমি মনে করি, নির্মাণ খাত বিনিয়োগের জন্য বিশেষত মর্টগেজ বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। এখানে সরকার প্রণোদনা দিতে পারেন।

সিমেন্ট খাতে বর্তমানে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে উদ্যোক্তাদের সামনে?

এ খাতের অনেক সমস্যাই আমরা ফেস করছি। টাকার অবমূল্যায়ন, বিশেষত নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। সেক্ষেত্রে প্রায় সবা কারখানা ২০২১ সাল থেকেই লোকসান দিয়ে আসছে। এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, যেগুলো আমরা ইমিডিয়েট সলভ করতে পারি। যেমন নির্মাণ শিল্পে এখনো আমাদের অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। পণ্য বিক্রি করে ব্যালেন্স শিটে লস থাকে। সেখানে আমি যখন অগ্রিম আয়করটা দিয়ে আসি, সেটিও আমার লসের সঙ্গে যুক্ত হয়। এ বিষয়গুলো সরকারের পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। আমরা বুঝি এগুলো। কিন্তু শিল্পকে রুগ্ণ করে তো আর বেশিদূর এগোনো যাবে না। শিল্পকে তো প্রথমে সারভাইভ করতে হবে। আমার মনে হয় সরকারের এ জায়গাগুলোয় যৌক্তিক পর্যায়েই কাজ করার সুযোগ আছে।

আমদানিতে সরকারকে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। উৎপাদন খাতে এর প্রভাব কেমন?

এটা বাস্তবতা। তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে যদি উৎপাদনশীলতা কমে, ভোক্তার কর্মসংস্থান কমবে। এখন তার কর্মসংস্থান কমেছে, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। এটি অত্যন্ত জটিল সমীকরণ। যেহেতু আমরা আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ, সেহেতু হয় রিজার্ভ বাড়াতে হবে, অথবা আমদানি কমাতে হবে। কিন্তু আমদানি কমালে উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। তাহলে রিজার্ভ বাড়ানো ছাড়া আপাতত অন্য উপায় নেই। সেক্ষেত্রে এক্সপোর্ট বাড়াতে হবে। তবে বিভিন্ন খাতের এক্সপোর্ট বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই আপাতত। গার্মেন্টস পণ্য রফতানি করে যে আয়টা আমরা করি, তার একটা বড় অংশ চলে যায় অ্যাকসেসরিস আমদানিতে। যেমন রেমিট্যান্স যেটা পাওয়া যায় পুরোটাই কিন্তু আপনি রিটেইন করতে পারেন। কিন্তু গার্মেন্টস এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে পুরোটা তো রিটেইন করতে পারেন না। ১৫-২০ শতাংশ হয়তো রিটেইন করতে পারেন। অবশিষ্ট অংশ কিন্তু আমদানি খাতে চলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ বাজেটে সরকারের মূল ফোকাস হওয়া উচিত রেমিট্যান্স কীভাবে ফরমাল চ্যানেলে বাড়ানো যায়। সে কষ্ট করে যে টাকাটা আয় করছে, সে চায় তার সর্বোচ্চটা যেন সে পায়। কিন্তু রেমিট্যান্সে যখন হুন্ডির সুযোগটা থাকবে, তাহলে সে সেদিকে আকৃষ্ট হবে। এটাকে সরকারের যেকোনোভাবে বন্ধ করতে হবে। সরকারের সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া প্রণোদনা দুই থেকে আড়াই শতাংশ যা দিচ্ছে, সেটি তো আছেই তার বাইরে আরো একটি কাজ করতে হবে। রেমিট্যান্স আর্নারদের সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া উচিত। আমাদের রেমিট্যান্স আর্নারদের কিন্তু আমরা খুব বেশি সামাজিক মর্যাদা দিই না। দেশে একজন প্রবাসী এলে ট্রেন, বাস, উড়োজাহাজ ইত্যাদিতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাকে যেখানে প্রায়োরিটি দেয়া উচিত, সেখানে বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অনেক বেশি হেনস্তা করার মাধ্যমে শুরু হয়। আমার মনে হয়, তাদের এখনই একটি ডাটাবেজের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। ডাটাবেজের আওতায় এনে তাদের একটি কার্ড প্রোভাইড করে বিভিন্নভাবে তাদের প্রণোদনা বাড়াতে হবে। কার্ডের মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির একটি ব্যবস্থা নিতে হবে।

অবকাঠামো উন্নয়নকাজের স্থবিরতায় কর্মসংস্থানের ওপর কোনো বড় সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন?

আমাদের নির্মাণ খাতের সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থান জড়িত। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্মাণ খাত হচ্ছে নিরেট কর্মসংস্থানের অন্যতম জায়গা। সেটা আপনি সারা পৃথিবীতেই দেখতে পাবেন। চীন শুরু করেছে কিন্তু নির্মাণ খাত দিয়ে। কভিড-১৯-পরবর্তী মন্দায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন বড় ধরনের বিল পাস করেছেন। বিলটা ছিল নির্মাণ খাতের জন্যই। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট পাস করা হয়েছে। নির্মাণ খাতই একমাত্র খাত, যেখানে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। গ্রামের ঠিক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কিন্তু নির্মাণ খাতের অর্থনীতির প্রভাব থাকছে। সম্প্রতি রিজার্ভ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও নির্মাণসামগ্রীর আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে খাতটিতে একটু চাপ পড়েছে। এ চাপকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। আমাদের জনসংখ্যা অনেক, কিন্তু সক্ষমতা অপ্রতুল। কর্মসক্ষমতা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণ খাতের পুরোটাতেই সরকারি নেতৃত্ব হবে না।

আপনি বলছেন নির্মাণ খাতের পুরোটাতেই সরকারি নেতৃত্ব হবে না। এক্ষেত্রে পথনকশা কী হতে পারে বলে মনে করছেন?

কাতার, সৌদি আরব ও জাপানের মতো যেসব দেশ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করে, তাদের এখানে আহ্বান করা যায়। বেসরকারি সেক্টরেও নির্মাণ খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। আমেরিকায় বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরই নেতৃত্ব দিচ্ছে নির্মাণ খাতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে বেসরকারি সেক্টরে নির্মাণ খাত খুবই দুর্বল। পাবলিক সেক্টরে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ব্যাপক বিনিয়োগ তৈরি করেছেন, এটা আরো ১৫-২০ বছর চালিয়ে যেতে হবে। নির্মাণ খাতের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টাকা পৌঁছে যাবে। তখন আস্তে আস্তে একটা জায়গায় পৌঁছে যাবে অর্থনীতি। এর একটা সুদূরপ্রসারি ফল আছে। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের একটি হলো ঘর। অর্থনীতি সে অবস্থায় পৌঁছালে মানুষের মধ্যে সেটার ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। নির্মাণ খাতে সেটাও একটা নতুন সম্ভাবনা তুলে ধরে। প্রাইভেট হোমের যে চাহিদা আমাদের দেশে রয়েছে, তার ১০-১৫ শতাংশও আমরা পূরণ করতে পারিনি। এখানে বিরাট একটা সম্ভাবনা রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন