সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের ওপর শুল্ক অনেক বেশি

আমিরুল হক , ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড সীকম গ্রুপ

করোনাকালীন আমাদের কঠিন একটা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। সরকারেরও তখন অনেক ধরনের সংকট ছিল। ওটা পার করে এসে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে নতুন একটা সংকটের মুখে পড়ি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়ে গেলাম। বর্তমানে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি কেমন?

বহির্বিশ্বের কোনো কিছু থেকেই আমরা ডিসকানেক্টেড না। আমরা ভালোমতোই কানেক্টেড। সেক্ষেত্রে মুহূর্তের মধ্যেই বদলে যায় সবকিছু। যদি বিশ্ব অর্থনীতির ব্যবস্থাটাকে আমরা কনসিডার করতে পারি তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে আরো মিশতে হবে। বিশ্বায়নটাকে আরো বুঝতে হবে। গ্লোবাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে শুধু আমরাই না আরো অনেক দেশকেই এখন বেগ পোহাতে হচ্ছে। তারাও বেশ ভুগেছে, বাংলাদেশও অনেক ভুগছে। এর থেকে বের হওয়ার রাস্তা আমাদের বের করতে হবে। আমাদের শুধু সমস্যাগুলো বললে হবে না, সে সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল আছি। আমাদের এফডিএকে ধরে রাখতে হবে, আমাদের ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স অফিশিয়ালি কীভাবে আসে সেটা দেখতে হবে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি যেসব ভোগপণ্য আমাদের খুব বেশি দরকার নেই, সেসব বিলাসবহুল পণ্য আনা আমাদের দরকার হবে না এবং অনেক কিছুতেই আমরা একটু স্যাক্রিফাইস করতে পারি। একটা শিশুর ডায়াপার বিদেশ থেকে আনতে হবে কেন? খাদ্যদ্রব্য যেগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয় সেগুলো আরো বেশি ত্বরান্বিত করতে পারে। কিন্তু যেসব প্রয়োজন নেই, সেসব অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বিদেশ থেকে আনব কেন? আপনি যদি শুধু ফলমূল এসবের আমদানি দেখান তাহলে সেটাও অর্ধ মিলিয়ন ডলার হবে অফিশিয়ালি, কিন্তু আনঅফিশিয়ালি সেটা বিলিয়ন ডলার। আপনি তো জানেন ফলমূলের ইন্টারন্যাশনাল ট্যারিফ রেট কোথায় কী হয়? আপনি ১৫ হাজার ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্চ আনবেন, ১৫-২০ হাজার ডলারে জিপ নিয়ে আসবেন। এসব পণ্যে বলে দেন এটা ইন্টারন্যাশনাল রেট। আপনি কার বা অন্যান্য গাড়ির শুল্কায়ন করেন তখন ইয়েলোবুক কাজ করে। এখানে ইয়েলোবুক কাজ করলেই হবে না, শুধু যারা আন্ডার ভ্যালু দিয়ে এলসি করছে তাদের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দরকার শিল্প-কারখানায় উৎপাদনশীলতা বাড়ানো।

আমাদের উৎপাদনমুখী যে শিল্প, সেটাকে বিবেচনায় রেখে সব পদক্ষেপ নিতে হবে। উৎপাদনের সঙ্গেই কর্মসংস্থানের বিষয়টা জড়িত। না হলে সাধারণ মানুষ চলবে কী করে? অর্থনীতির চাকাটা কীভাবে ঘুরবে? আপনাকে উৎপাদনটা চালিয়ে যেতেই হবে। এক্সপোর্ট মার্কেটটাকে এক্সপান্ড করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা আমাদের সব চেষ্টা করব যাতে আমাদের এক্সপোর্ট বাজারটাকে আরো লার্জ করা যায়। এক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বছরে ২৫-৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়া দরকার। তাহলে উৎপাদন বাড়লে কস্ট অব প্রডাকশন কমবে এবং আমাদের এজ ওভার অ্যান হারভেস্ট আমরা ভালো অবস্থানে যাব। আর আঞ্চলিক অনেক সমস্যার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশমুখী হওয়ার অনেক সুযোগ আছে। বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশমুখী হওয়ার অনেক কারণ আছে। ভারতের ৬০ হাজার কোটি টাকার ফরেন কারেন্সি আছে। আমরা তাদেরই পার্শ্ববর্তী দেশ। আমাদেরও সেম এক্সিলারেশেন থাকা দরকার।  আমাদের স্বাধীনতার পরে ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে, আমাদের আর নতুন দেশ বললে হবে না। আমাদের যারা উদ্যোক্তা আছে তারা দক্ষ, কর্মিবাহিনী দক্ষ। এখানে আমাদের অবশ্যই অর্জন করতে হবে। আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের লক্ষ্য নির্ধারিত, সেটা আমাদের অর্জন করতে হবে।

আপনি নির্মাণ খাতে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। উৎপাদনমুখী কর্মযজ্ঞ বহির্বিশ্বের সঙ্গে আপনার কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি দেশের উদ্যোক্তাদের বেকায়দায় ফেলে দেয়, পরবর্তী সময়ে আবার দামটা পড়তেও থাকে। কিন্তু আমাদের ভোক্তাব্যয়ে তার সুফল পাওয়া যায় না। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা যখন কমে যায়, তখন চাহিদাতেও একটা প্রভাব পড়ে। এখানে কি এমন কোনো পরিস্থিতি রয়েছে?

গত তিন-চার বছর ভোগ্যপণ্যের দাম চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সয়াবিন তেলের দাম ছিল হাজার ৭০০ থেকে হাজার ৮০০ ডলার। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অবশ্যই ক্রেডিট দিতে হবে। সে গত মাসে হাজার ৭০০ ডলারের ইমপোর্ট করেছে, মার্কেটে আসতে আসতে তা হাজার ৬০০ ডলার। গত তিনটা বছর আমদানিকারকরা ইমপোর্ট করেছে প্রাইস ট্যাগ নেভিগেট করেছে। এদিকে আবার ডলারের দাম বেড়েছে। ৮৫ টাকা ডলারে যে মালটা বিক্রি করে দিয়েছে সেই পেমেন্টটা যখন ডিউ হলো তখন তাকে দেয়া হলো ১১০ টাকা। এটা একটা ব্যাপার। আগামী বাজেটে এটা আমাদের সবার অ্যাড্রেস করা দরকার। ডলারের রেট কী হবে সেটা ঠিক করা দরকার। ডলারের রেট যে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা, সেটা ইমপোর্ট রেইজ করছে কিনা। সেটা যদি তা না করে তাহলে এমন রেট কেন ঘোষণা করছেন যেটা কনফিউশন তৈরি করছে, ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। আমরা বলছি ব্যাংক হরিলুট করছে আর ব্যাংকগুলো বলছে আমরা ডিলেমাতে থাকি। এই ডিলেমাতে না থেকে চলেন সব ঠিকঠাক করি। এমন জায়গায় নিতে হবে যেখানে জনগণ কমফোর্টেবল হবে। ডলার রেট বাড়ছে। সুখবর হলো আন্তর্জাতিক বাজারে সবকিছুর দাম কমছে। কারণ বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক মন্দা তো আছেই। এটা সবাই হয়তো বলে না, কিন্তু এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। অর্থনৈতিক মন্দা চলে এসেছে এবং সেটা কিছু সময় স্থায়ীও হতে পারে। আমাদের বাজেটে ট্যাক্সের বিষয়টা হলো আমাদের যারা দেয় তাদের ওপরেই ট্যাক্স বাড়ানো হয়। ট্যাক্সের নেটওয়ার্ক কিন্তু আমরা বাড়াই না। শহরে থাকলে আমি সবচেয়ে বেশি ট্যাক্সের আওতায়, আমি চোখে পড়লাম বেশি। এটা খুব দুঃখজনক। আমরা যারা ট্যাক্স দিই তাদের ওপর আরো বেশি ইমপোজ না করে যারা ট্যাক্স দেয় না তাদের ট্যাক্স নেটওয়ার্কে ইনক্লুড করা দরকার। আরেকটা হলো ইনভেস্ট ইন ম্যাটেরিয়াল। যাচ্ছেতাইভাবে ট্যাক্সের ট্যারিফ এটা ওটা পরিবর্তন করা উচিত না। আরো একটা বিষয় হলো এআইটি (অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স), কোনো সভ্য দেশে এমন হয় না। সবচেয়ে যেটা বেদনাদায়ক আপনি ট্যাক্সটা ঠিক করে দিয়েছেন। - বা শতাংশ নিবেন, আপনি ব্যবসায় লসও করতে পারেন, লাভও করতে পারেন। এনবিআরকে বলতে হবে যে আমি ব্যবসায় লাভ করবই। কারণ লস করলেও এআইটি দিতে হবে। বাংলাদেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে একটা বিষয় আছে, আপনি লস করতে পারবেন না। ডলারের কারণে লস করেছেন বা যে কারণেই করেন, লস করলেই আপনি ভালো নন। লস সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো করতে পারবে কোনো মানা নেই। লিস্টেড কোম্পানির কোনো প্রজেক্টে কস্ট বাড়তে পারবে না। আইনটা এভাবে হয় না। আইন সমভাবে হয়।

ভ্যাটের আওতা বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তারা বলেন, প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানো নিয়ে মনোযোগী না এনবিআর।

যে কর দেয় তার ওপরেই চাপায় এনবিআর, যে দেয় না তার ওপর কিছু নেই। এটা খুব খারাপ ব্যবস্থাপনা। আপনি ফিক্সড করে দেন। বাজেট ব্যবস্থাপনায় ট্যাক্স আহরণ না হলে তো দেশ চলবে না। অনেক দেশে ইনল্যান্ড ট্যাক্স দিয়েই অর্থিনীতির অনেক কাজ হয়। এটা বিন্যাস করা দরকার, ফর্মুলায় আসা দরকার। এক. যারা ট্যাক্সের আওতায় নেই তাদের আওতায় আনা আর দুই. অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স। আমার ওপর ট্যাক্স হয়নি। আমি দিয়ে দিলাম, এটা আমাদের ক্যাশ ফ্লোতে কাজ করে না। আমি আমার ব্যাংকের পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট দিয়ে ড্র করে আপনাকে দিচ্ছি। সেটা তো শেয়ারহোল্ডারদের অসুবিধা। আবার ট্যাক্স দেয়ার সময় চিন্তা থাকে আমি যদি বেশিও দিই তাও তো আমাকে রিফান্ড করবে না। এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা সবসময় বলে আসছি, কাস্টমস হাউজের পণ্য ছাড় করার ব্যবস্থা বিশ্বায়নের সঙ্গে যায় না। আপনি ইন্ডাস্ট্রিতে চাইবেন বিশ্বায়ন আর অনেক পণ্য কাস্টমসে এক মাসের বেশি পড়ে আছে। এসব সুরাহা করা দরকার। এসব জায়গায় সুশাসন দরকার। আরেকটা বিষয় হলো এনবিআরের চেয়ারম্যান, মেম্বার দুই বছরের জন্য আসেন। বাইরের থেকে এসে দুই বছরে কারো যত যোগ্যতাই থাক সব বুঝে ওঠা সম্ভব না। তিন বছরের জন্য আসেন চট্টগ্রাম বন্দর চালানোর জন্য। তারপর চলে যান। আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একজন অফিসার উঠলে, তিনি সেই পোর্ট চালাতেন। আনপ্রফেশনালদের জন্যই কিন্তু বে টার্মিনাল হয় না। দীর্ঘ সময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।

বন্দর ব্যবস্থাপনাটা আসলে কী ধরনের?

আমরা যখন কোর্টে যাই তখন বলি, দেয়ার মাস্ট বি গুড জেশ্চার। কিন্তু কাস্টমসের উনারা মনে করেন, আমরা প্রভু উনারা দাস। বন্দর ব্যবস্থাপনায়ও একই। যারা বন্দরে বসে আছেন তারা মনে করেন আমরা প্রভু আর এরা দাস। কিন্তু এর যে ভিন্ন দিক আছে তা তারা ভুলে যায়। বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসা একটা অভিশাপ। যারা করছে তারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে করছে। এলসি খোলা একটা ঝামেলা। এলসি খুলে পণ্য আনা বিক্রি করা কঠিন।

ব্যবসা পরিচালনায় অনেক চ্যালেঞ্জের কথা শুনে থাকি। আপনার মতে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

ব্যবসাটাকে সহজীকরণ করলে অনেক চ্যালেঞ্জ কমবে। আপনি অনলাইনে সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সটা করতে পারবেন। এটা সিম্পল ব্যাপার। ওয়ান স্টপ সার্ভিস আপনি করতে পারেন। একেকটা সময় একেকটা বিষয় রিপ্লেসমেন্ট হয়। আমরা যদি বিশ্বায়নে যেতে না পারি, এসবের যদি সুরাহা করা না যায়, তাহলে কেউ বিনিয়োগ করতে আসবে না। কোনো বিনিয়োগকারী এলে লোকাল উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞেস করবে আপনারা কেমন সাফার করছেন। বন্দর, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় মিলে ব্যবসায়ী ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের জন্য, উদ্যোক্তাদের জন্য একটা জায়গা বানাতে হবে, যেখানে সবকিছুর লাইসেন্স পাওয়া যাবে। প্রত্যেকটা লাইসেন্স পাওয়া যাবে। তাহলে একটা সুরাহা পাওয়া যাবে। এসব ব্যাপারে আমাদের সুশাসন হওয়া দরকার।

অনিশ্চয়তার মধ্যে কখনো বিনিয়োগ আসে না। ইন্ডাস্ট্রি করতে গেলে আপনাকে সোজা পথ তৈরি করতে হবে, আপনার কাছে সবাই সুশাসন চাইবে। কোনো ধরনের ঘুষ-দুর্নীতি থাকবে না। শিক্ষাও একটা ব্যাপার। এটাও বাজেটে দেখার বিষয় আছে। বুয়েট থেকে পাস করার পরে কেউ এসিল্যান্ড হবে কেন, সরকারি মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাস করার পরে কেউ এসিল্যান্ড হবে কেন? উনি ট্যাক্সে চাকরি করবে কেন? আপনি দেশের টাকাও খরচ করেছেন, আপনার মোটিভটাও স্বচ্ছ না। এটা মেনে নেয়া যায় না।

সরকারি কেনাকাটার সঙ্গে আপনাদের নানা কিছু বাস্তবায়নও চলছে। সেটা কি কোনোভাবে প্রভাব ফেলবে?

এটাতে প্রাইমারিলি আমরা সবাই চেষ্টা করছি। পরে পুরোপুরি চেষ্টা করা হবে কীভাবে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আমাদের বিশ্বায়নের চিন্তা করতে হবে, ফরেন কারেন্সি আনতে হবে। তাই আরো ইনভেস্টমেন্ট আনতে হবে। তাছাড়া সবচেয়ে জরুরি বিষয় আমাদের চেষ্টা করতে হবে যারা বিদেশে কাজ করে তাদের আয়গুলো অফিশিয়াল চ্যানেলে আনতে হবে। তাহলে অর্থনীতিতে স্বস্তি আসবে।

আগামী বাজেটের জন্য আপনার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রয়েছে?

আমাদের ওপরে যে ট্যাক্সটা ইমপোজ করা হয়, সেটা যেন কনসার্নে আনা হয়। মধ্যবর্তী কাঁচামাল হিসেবে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের ওপর শুল্ক অনেক বেশি। আমাদের বিষয়টা মানবিকভাবে দেখার জন্য অনুরোধ করব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন