বাজেটটা যেন করের দিক দিয়ে একটু সহনীয় হয়

মানোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএচেয়ারম্যান, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ

বর্তমানে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা মন্থর গতি দেখা যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব সংকট মোকাবেলার দিকনির্দেশনা থাকবে বলে সবার প্রত্যাশা। আগামী বাজেট ঘিরে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা কী?

অর্থনীতি বর্তমানে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। আমরা ১৫-১৬ বছর ধরে যেটা দেখছি যে অর্থনীতি বেশ উচ্চপ্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে গেছে। ধরনের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির পর দুই-তিন বছর কিছুটা শ্লথগতি আসতেই পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাহ্যিক কারণে শ্লথগতি আমরা একটু আগেই পেয়ে গেছি। এক্ষেত্রে সবাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বাংলাদেশ বেশ অ্যাগ্রেসিভ ছিল বলেই আজকে জায়গায় এসেছে। কিন্তু এর পরও যদি আমরা টার্গেট ধরে রেখে দিই যে এই সময়ের মধ্যে এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের সময়সীমা রয়ে গেছে। জায়গাগুলোতে আমাদের কিছুটা ছাড় দিতে হবে। কেমন বাজেট চাই যদি জানতে চান তাহলে আমি বলব, বাজেটটা যেন করের দিক দিয়ে একটু সহনীয় হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। অর্থনীতিকে সহায়তা দিতে চাইলে আপনাকে অবকাঠামো থেকে সরে গেলে চলবে না, ধারাবাহিকভাবে নির্মাণ করে যেতে হবে। এর সঙ্গে দেশের হাজার ৬০০ পণ্য সেবা জড়িত। অবকাঠামো বলতে আমি শুধু রাস্তাঘাটকে বোঝাচ্ছি না। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ সবকিছুই এর মধ্যে রয়েছে। বাজেটের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে ব্যয় নির্ধারণ হওয়ার পর এর ভিত্তিতে আয় নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের যেসব জায়গায় অদক্ষতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। অদক্ষতা দুর্নীতির কারণে যাতে অর্থের অপচয় না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলে স্বল্প খরচের তহবিলের সুযোগ কমে যাওয়া, রফতানি প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। ফলে এর জন্য এখনই আমরা প্রস্তুত কিনা সেটি ভেবে দেখা দরকার। বিদেশী সংস্থা কিংবা অন্য কোনো দেশের মডেলে নয় বরং আমাদের নিজেদের অবস্থান স্বার্থের দিকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

একদিকে আপনারা বিভিন্ন ধরনের ছাড় প্রত্যাশা করছেন। অন্যদিকে আইএমএফের শর্ত অনুসারে সরকারের ওপর কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর চাপ রয়েছে। পরস্পর বিপরীতমুখী পরিস্থিতিকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?

বিশ্বের অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে আসতে আরো তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। ফলে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছর আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। অবস্থায় আপনাকে আগে নিজের কথা চিন্তা করতে হবে। প্রতিটি দেশ নিজের কথা আগে নিজে চিন্তা করছে। এত কিছুর পরও বিধিনিষেধ থাকা দেশ থেকে অনেকে জ্বালানি তেল খাদ্যশস্য আমদানি করছে। শুধু সংখ্যা দিয়ে বিচার না করে মানুষের কথাও ভাবতে হবে। জনগণের করের অর্থে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দেয়ার আমি ঘোর বিরোধী। প্রয়োজনবোধে এগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হোক। আমাদের প্রধান আমদানি বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে চীন-ভারত রয়েছে। তারা প্রতি বছর আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করে যা লাভ করে সেই অংশটি আমরা তাদের কাছে বাণিজ্য ঋণ হিসেবে চাইতে পারি। প্রয়োজনবোধে তাদের মুদ্রায়ই দিক। অর্থ দিয়ে আমরা দুই-তিন বছর কিছুটা স্বস্তিতে চলতে পারি। আমি এত শর্তের বেড়াজালে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার পক্ষপাতী নই। আরেকটি বিষয় আমরা বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছি, সেটি ভালো কথা। কিন্তু আবার একই সঙ্গে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার সংবাদও আমরা দেখতে পাই। যেখানে আমরা বিদেশী বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছি সেখানে অর্থ পাচার কাম্য নয়। কেন দেশে অর্থ বিনিয়োগ না হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে এর কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম মিয়ারমারের মতো দেখগুলো বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। অথচ তাদের চেয়ে আমাদের এখানে সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

দেশ থেকে কেন অর্থ পাচার হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

বেশকিছু কারণে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি প্রজন্ম দেশের বাইরে চলে গেছে। বিষয়টি আগামী বছর দশেক আমাদের ভোগাবে। যারা চলে গেছে তারা হয়তো দেশে থাকা তাদের সম্পদ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো আগে যাদের কাছে অপ্রদর্শিত অর্থ ছিল তারা সেটি দেশেই বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু বর্তমানে তারা আর দেশে বিনিয়োগ করছেন না, বরং বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাছাড়া অনেকের মধ্যেই বিদেশে সেকেন্ড হোম তৈরির আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এসব কারণেই দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। আমি দেশপ্রেমের কথা বলতে পারি, ভয় ভীতির কথা বলতে পারি। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে কেন মানুষ দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে সেটি চিহ্নিত করা। আমি টাকা কামাচ্ছি দেশে কিন্তু খরচ করছি বিদেশে এটা বন্ধ করতে হবে। আরেকটি বিষয় আমাদের এখানে অনেক কিছুই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় যেগুলো আমরা চাইলেই দেশে উৎপাদন করতে পারি। ধরনের

পণ্য দেশেই যাতে উৎপাদন করা যায় সেজন্য সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে আমরা অর্থ সাশ্রয় করতে সক্ষম হব।

তৈরি পোশাকের বাইরে তো অন্যান্য পণ্যের রফতানি সেভাবে বাড়ছে না।

রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে একক নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। রফতানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের কথা বলা হলেও সেটি হয়ে উঠছে না। রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে যে খাতে সেটি হচ্ছে জনশক্তি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের জনশক্তির বড় অংশই বিদেশে নিম্ন আয়ের কাজে জড়িত আছে। এদের যদি আমরা শিক্ষা দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি রেমিট্যান্স আয় করা সম্ভব। আমাদের এখানে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এসব পণ্যের রফতানি বাড়ানোর দিকেও আমরা জোর দিতে পারি। এরই মধ্যে কিন্তু প্রাণ গ্রুপ জাতীয় পণ্য রফতানি করে সফল হয়েছে। আমি এমন কোনো দেশ নেই যেখানে গিয়ে তাদের পণ্য দেখিনি।

কভিডের সময় থেকেই নানামুখী সংকটের মুখে পড়ে রড-সিমেন্ট খাত। গত বছর থেকেই আমরা পণ্য দুটির দামে বেশ ঊর্ধ্বগতি দেখছি। কারণে সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদাররা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের রড-সিমেন্ট খাতের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই?

এক বছরে ৩০ শতাংশের মতো টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সে তুলনায় রড-সিমেন্টের দাম কমই বেড়েছে বলে মনে হয়। আমাদের এখানে বিভিন্ন ধরনের ক্রেতা রয়েছেন। একশ্রেণীর ক্রেতা দাম যাই হোক না কেন রড কিনবেই। আরেক শ্রেণী দাম বাড়লে কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেবে। আরেকটি শ্রেণী রয়েছে যারা খুব সংবেদনশীল, দাম বাড়লেই তারা কিনতে পারবে না। আমার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি টন রডের দাম ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত থাকলে সেটি ক্রেতা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। দাম এর বেশি হলে রডের চাহিদা কমতে থাকে। যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে আমরাও সন্তুষ্ট নই। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার কারণে আমরা বাধ্য হয়ে দাম বাড়িয়েছি। দাম বাড়ার কারণে আমাদের বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।

গত বছর থেকেই মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। ক্রয়ক্ষমতা কমলে পণ্যের বিক্রিও কমে যায়। আনোয়ার গ্রুপের ব্যবসা বিভিন্ন খাতে বিস্তৃত। আপনাদের ব্যবসায় মূল্যস্ফীতির প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাই।

বাংলাদেশের এমন কোনো থানা নেই যেখানে আমাদের রিটেইলার নেই। এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে আমাদের পণ্য যায় না। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে আমি ভীষণভাবে সংযুক্ত। গ্রাম বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। গ্রামীণ অর্থনীতি ভালো থাকলে দেশের অর্থনীতিও ভালো থাকবে। এবার যেটি দেখা যাচ্ছে সবার মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে, তাই আমি বছর বাড়তি খরচ করব না। পাশাপাশি ক্রেতার ক্রয় সক্ষমতাও কমে গেছে। এর জন্য অর্থনীতিতে একেবারে নিচের পর্যায় থেকে প্রভাব পড়ছে। এর প্রভাব একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে অনুভূত হবে। আমি ৩০ বছর ধরে আনোয়ার গ্রুপের সঙ্গে আছি। এবারের শ্লথগতি আমার গায়ে বিঁধছে। কভিডেও আমাদের রকম পরিস্থিতি ছিল না। জায়গায় আমি কিছুটা শঙ্কা বোধ করছি।

আপনার শঙ্কাটা কী নিয়ে?

শঙ্কাটা হচ্ছে যে একটি ঘটলে আরেকটি ঘটবে, একটার প্রভাব আরেকটার ওপর গিয়ে পড়বে। সার্বিকভাবে পুরো দেশেই শ্লথগতির কারণে ব্যবসা কমে আসবে। বাংলাদেশকে ভোক্তাভিত্তিক অর্থনীতি বলা হয়। ভোগ কমে গেলে এর প্রভাব সবার ওপরে পড়বে। আমার ভয় হচ্ছে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ব্যবসায়ীদের যে লোকসান হয়েছে এক্ষেত্রে কোনো ভর্তুকি না দিয়ে ক্ষতির পরিমাণকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে যদি গ্রাহককে পরিশোধ করার সময় দেয়া হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে। একইভাবে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে চলতি মূলধনের সীমা বেড়ে যাওয়ায় সেটিকে সমন্বয় করে দিতে হবে। সমস্যা আসবে, সমস্যা সমাধান করতে হবে। সমস্যা নিজে নিজে ঠিক হয়ে যাবে সেটি আমি বিশ্বাস করি না। আপনাকে সক্রিয় থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

বছরের বাকিটা সময় কিংবা আগামী বছরটা কেমন যাবে বলে মনে হয় আপনার?

তাত্ক্ষণিকভাবে বলতে গেলে তো আমি বলব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছি। আমি খুবই আশাবাদী মানুষ, নেতিবাচক কিছু বলা পছন্দ করি না। তবে আমার সতর্ক বাণী হচ্ছে যে একটি বছর তো কঠিন যাবেই। আর এটি সংশোধন করে আসতে আসতে আরো দুই তিন বছর চলে যাবে। আমরা ভয় যে জায়গায় যদি সংখ্যাভিত্তিক অর্থনীতি চিন্তা করি তাহলে এক্ষেত্রে যেসব সংস্কার দরকার সেগুলো হয়তো নাও পেতে পারি। এটা যদি না পাই তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। এতে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়বে।

আপনাদের মধ্যে না পাওয়ার শঙ্কা কাজ করছে কেন?

আমলাতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের একটা দূরত্ব রয়েই গেছে। এটি বাড়তে থাকলে একটা সময় গিয়ে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলব। তখন আর আমরা তাদের কাছে যেতে চাইব না। তাছাড়া সবসময় কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সব জায়গায় দেখা যায়। ঠিক আছে ওনারা বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এর বাইরেও আরো অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের কথাও তো শুনতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ী যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা না বললে আপনি প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন না।

 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন