শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এলসি দিতেই হবে

আমীর আলীহুসাইনব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসআরএম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির শুরুর দিক থেকেই অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টেছে। পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে কীভাবে দেখতে চাইবেন?

মূল্যস্ফীতিসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে। আসছে বাজেটে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিলাসপণ্যে কড়াকড়ি কিংবা শুল্ক-কর বাড়ানো হতে পারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। উৎপাদন, আমদানি রফতানি পর্যায়ে আরোপিত সব শুল্ক কর এবং খালাস প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করা জরুরি। শিল্প উৎপাদন যাতে জ্বালানি সংকটে ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। রেন্টাল একটা পর্যন্ত দরকার ছিল কিন্তু পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। ইলেকট্রিসিটি কস্ট বাড়ালে বেকায়দায় পড়তে হয় উদ্যোক্তাদের। আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হলে আমাদের আমদানি প্রতিস্থাপনে জোর দিতে হবে, অর্থাৎ যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেসব পণ্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। যেমন নির্মাণ খাতেরই এমন অনেক পণ্য আছে, বর্তমানে দেশেই উৎপাদন শুরু করায় যেগুলো আমদানির আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই কিংবা খুব বেশি আমদানির দরকার নেই। নির্মাণ খাতের ইস্পাতপণ্য আমরা দেশের স্থানীয় বাজারের জন্য মূলত উৎপাদন করলেও কিছু রফতানিও হয়। এটা যদি আরো বাড়াতে হয় তাহলে ফ্রেইট কমিয়ে আনতে হবে। ফ্রেইট না কমলে রফতানি পদক্ষেপ অনেক কঠিন হয়ে যায়। এজন্যই উপযুক্ত প্রণোদনা প্রয়োজন। অন্তত পাঁচ বছরের জন্য সরকার এটা দিয়ে দেখতে পারে। লোকাল ইন্ডাস্ট্রিকে সাপোর্ট করলে বৈদেশিক মুদ্রা তো এখানেই সাশ্রয় হবে।

বাজেটে যে পরিমাণে ব্যয় ধরা হয়, তার চেয়ে রাজস্ব আয় অনেক কম। নিয়ে রাজস্ব লক্ষ্য পূরণের চাপে থাকে এনবিআর।

রাজস্ব আহরণের চাপ থাকে এটা আমরাও বুঝি। এখন যেমন ইচ্ছেমতো শুল্কায়ন হয় যেটা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য চাপ তৈরি করে। একটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন বাড়িয়ে দেয়া হয় শুধু রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে, এটা তো যুক্তিসংগত হতে পারে না। টার্গেট পূরণ হচ্ছে না কারণ আমদানি অনেক কমে গেছে। কিন্তু দেশে তো এখনো অনেক আন্ডার ইনভয়েসিং হয়। এগুলো বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্যিক পরিসর বড় অন্তত সেসব দেশের কাস্টমসের সঙ্গে এমন চুক্তি করা যেতে পারে যাতে সে দেশ থেকে যা রফতানি হচ্ছে সেটির ইনভয়েসের কপি সহজেই পাবে আমাদের দেশের কাস্টমস। একটা ডাটাবেজ থাকবে যেখানে শুল্ক কর্মকর্তারা চাইলে চেক করতে পারবেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধরনের পদ্ধতি থাকলেও আমাদের দেশে ব্যবস্থা কেন গড়ে ওঠেনি আমার জানা নেই। অথচ আন্ডার কিংবা ওভার ইনভয়েসিং বন্ধের জন্য এটা একটা কার্যকর ফর্মুলা। কাস্টমস হাউজগুলোকে অন্যান্য দেশের কাস্টমসের সঙ্গে সংযুক্ত করে রফতানি গন্তব্যে জমা দেয়া চালান দেখে বাংলাদেশ কাস্টমসে ঘোষিত মূল্য যাচাই করার উদ্যাগ নেয়া হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও সুরক্ষা হবে। আমি বিশ্বাস করি রাজস্ব ফাঁকি অনেক নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

রাজস্ব আয় বৃদ্ধির আরো কোনো পরামর্শ আছে আপনার?

আয়ের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর আমদানি শুল্ক হলো তিনটি প্রধান খাত। কোন কোন খাত থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব ব্যাপারে অনেক বেশি বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে এনবিআরের। আরো স্পষ্ট করে যদি বলি প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আয়কর খাতকে বড় করতে হবে। কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) যত লোক আছেন, তার অর্ধেকও করের আওতায় নেই। আসলে কর সংগ্রহের আরো ভালো কৌশল তৈরি করতে হবে সংস্থাটিকে। সামর্থ্য বেশি, তাই তাদের কাছ থেকেই বেশি আদায় করার মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। করহার কমিয়ে করের আওতা বাড়িয়ে কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ এবং ব্যবসাবান্ধব করা গেলে করপ্রাপ্তি ক্রমাগত হারে বেড়ে যাবে। দেখা গেছে যারা বেশি কমপ্লায়েন্ট ওদের থেকে ঘুরেফিরে বেশি কর আদায়ের চাপ তৈরি হচ্ছে। যদিও কর আওতা প্রসারিত করা উচিত এবং এর যথেষ্ট সুযোগও আছে বলে আমরা মনে করি। জন্য অ্যাফোর্ট দিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এনবিআরের রকম ক্যাপসিটিও নেই। সরকারকে জনবল নিয়োগ দিয়ে এনবিআরকে সেই সাপোর্ট দিতে হবে। যারা দিচ্ছে তাদের থেকে আরো বেশি নিয়ে, এটা উদ্যোক্তাদের জন্য আসলেই একটা চাপ তৈরি করছে। এনবিআরের ক্যাপাসিটি এমনভাবে বাড়াতে হবে যেন ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরেও ওদের রিচ করার ক্যাপাসিটি সারা বাংলাদেশে থাকে। এছাড়া বিদ্যমান কোম্পানির কাছ থেকে আরো ট্যাক্স সংগ্রহের দিকে মনোযোগ না দিয়ে ট্যাক্স নেটওয়ার্ক আরো প্রসারিত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগোতে হবে সরকারকে। ব্যাপারে সারা দেশে এনবিআর উইংগুলোকে নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। এতে নতুন নতুন করদাতা আসবে এবং রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শিল্পের উৎপাদন প্রসারের সঙ্গে কর্মসংস্থানের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির দিকটি বাজেটে কীভাবে আসতে পারে?

কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির দিকটি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে নতুন বিনিয়োগ কর্মসংস্থান প্রয়োজন। উৎপাদনশীল খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবেই অর্থনীতিতে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হবে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাজেটকে শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাবে না দেখে একটি অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

ডলার সংকট নিয়ে কিছু বলবেন?

রিজার্ভ কমে যাওয়া ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণপত্র খোলা পণ্য আমদানিতে সমস্যা যত দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যায় ততই শিল্প গতি পাবে। ইন্ডাস্ট্রির জন্য এলসি দিতেই হবে।

বন্দর ব্যবহারকারী হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠান শীর্ষে রয়েছে তাতে বিএসআরএম অন্যতম। বন্দরসেবা কীভাবে দেখতে চান?

বন্দর সুবিধা বাড়ানো নিয়ে জোর দেয়া উচিত বাজেটে। জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমিয়ে আনতে না পারার কারণে কি শুধু ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন? যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে গেছে এর অংক মোটেই ছোট নয়। সরকার মাতারবাড়ী বন্দর বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়েছে, এটা খুবই ভালো ব্যাপার। বে টার্মিনালের নির্মাণকাজ বছরের পর বছর শুধু শুনেই এসেছি। বে টার্মিনাল হলে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা সহজে বৈদেশিক বাণিজ্যের কাজ সম্পাদন করতে পারতেন। আরেকটি বিষয় দেখেছি চট্টগ্রাম বন্দরের ফান্ড যেভাবে ছোট হয়ে আসছে সেটি সুখকর হবে বলে মনে করছি না।

আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল যেমন বেড়েছে, আবার পড়েছেও। কিন্তু ভোক্তাকে ঠিকই উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

হাই ট্যাক্স কালচার, হাই ইউটিলিটি কস্ট, হাই ডলার রেইট, যুদ্ধ সবকিছু মিলেই তো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কাঁচামালেল দাম বেশ ভালোভাবে পড়েছিল তখন তো আমরা এলসিই খুলতে পারিনি। ফলে সে সুযোগটা কাজে লাগানো যায়নি। কাঁচামাল খরচ বাড়ার কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ ৩০ শতাংশও ছাড়াল। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমল এলসি সংকটের কারণে কেনা যায়নি। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনায় আজ যে দামে ডলার হিসাব করছি পেমেন্টের সময় সেটা কোথায় দাঁড়াবে আমরা তো জানি না। এভাবে চলতে থাকলে ইকোনমি আরো স্লো হয়ে যাবে। এছাড়া ম্যাটেরিয়ালস যদি প্রয়োজনমতো আমদানি করতে না পারি, আউটপুট যদি কমে যায় ধীর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে তাহলে জিডিপি গ্রোথ কোথা থেকে আসবে। বিলাসবহুল পণ্যের যেমন কড়াকড়ি আরোপ করবে, অন্যদিকে জরুরি খাদ্যপণ্যে এবং শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ ঠিক রাখার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ইস্পাত। আসন্ন বাজেটে খাতে নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব রাখবেন?

ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ সহজ সাশ্রয়ী করতে এই করছাড় দেয়ার কথা বলি আমরা। কাঁচামালের ওপর শুল্ক কমাতে হবে। ভ্যাট কমাতে হবে। নির্মাণ খাতে মিনিমাম ট্যাক্স কমাতে হবে কিংবা উঠিয়ে দিতে হবে। কারণ ব্যবসা কখনো লাভ হবে, কখনো লোকসান হবে। ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপসহ সব কাঁচামালের আমদানি শুল্ক কমানো উচিত বর্তমান ব্যবসা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে। কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখা জরুরি। আমদানি পণ্যের মূল্য নির্ধারণের একটি ভালো সিস্টেম তৈরি করা জরুরি। আরেকটা হলো এলটিইউ থেকে রিফান্ড না পাওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ভালো অংকের টাকা আটকে আছে প্রক্রিয়ায়। টাকাটা ফেরত পেলে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞেই যুক্ত হবে। প্রবণতা কিন্তু ব্যবসা বিনিয়োগ পরিপন্থী।

 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বণিক বার্তার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন