কৃষি যন্ত্রাংশের ভর্তুকি মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করতে হবে

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি দ্য মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড। দেশের সার্বিক কৃষি খাত আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ খাতে প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাশার নানা বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাদিদ জামিল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত বিপ্লব

বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত কৃষিজমি কমছে। সেই সঙ্গে কমছে কৃষি শ্রমিকও। ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশে কৃষিজমি প্রতিনিয়ত কমছে। কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে থাকছে না। তারা অন্য পেশা বেছে নিচ্ছে। তাহলে কৃষি ধরে রাখবে কে? ফসলের মৌসুমে দেখা যায় ফসল কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায় না। সেজন্য কৃষিযন্ত্রের প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারের বিকল্প নেই। যেখানে কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটতে মাত্র - শতাংশ শস্য নষ্ট হয়। অন্যদিকে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কৃষকরা যদি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফসল কাটে তাহলে ১০-১২ শতাংশ শস্য নষ্ট হয়। ফলে যান্ত্রিকীকরণের কারণে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ ৩০-৪০ শতাংশ কমে যাচ্ছে অন্যদিকে শস্য নষ্টও কম হচ্ছে। এতে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। আবার সময়ও কম লাগছে। কারণে যন্ত্রের বিকল্প নেই।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ব্যবহার কতটুকু বেড়েছে?

ইদানীং আমরা কম্বাইন হারভেস্টারের প্রতি বেশি জোর দিচ্ছি। প্রতিবছরই আমাদের কম্বাইন হারভেস্টারের বিক্রি ৩০-৪০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে এবছর ট্রাক্টরের বিক্রি কিছুটা কমেছে। এর বড় কারণ হলো করোনা-পরবর্তী সময়ে ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খোলা নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। ফলে ট্রাক্টর বিক্রি আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ কমেছে। তবে সার্বিকভাবে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে।

দেশের জমিগুলো সমান্তরাল নয়। আবার অনেক জমিতে যন্ত্র নামানো যায় না। এক্ষেত্রে করণীয় কী?

অনেক সময় দেখা যায় একই জমিতে একই সময়ে যদি ধান না লাগানো হয়, সেক্ষেত্রে হারভেস্টের সময় সমস্যা হয়। এছাড়া একই জাতের ধানও করতে হবে। সরকার একই এলাকায় একই সময় ধান লাগানোর জন্য সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি চালু করেছে। এতে কৃষিজমির মালিকরা এর উপকারিতা বুঝতে পারছেন। ট্রাক্টর বা কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের ক্ষেত্রে জমি যদি সমান্তরাল নাও হয়, তাতেও সমস্যা হয় না। তবে বেশি উঁচু-নিচু হলে সমস্যা হতে পারে।

কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বা কম্বাইন হারভেস্টারের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ৫০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। আমরা এবার যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তা হলো, সরকার থেকে আমাদের ভর্তুকি মূল্য পরিশোধে দেরি হয়েছে। যার প্রভাবে বোরো মৌসুমে আমরা খুব বেশি কম্বাইন হারভেস্টার আনতে পারিনি। সরকার যদি ভর্তুকি মূল্য দ্রুত পরিশোধ করত, তাহলে বছর যন্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়ানো যেত। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সরকারের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ভর্তুকি মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে আগের তিনবছর যেভাবে আমরা পেয়ে এসেছি সেভাবে যেন দেয়া হয়। তাহলেই যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে।

আপনি বলেছেন, কৃষিযন্ত্র আমদানিনির্ভর হওয়ায় করোনা-পরবর্তী সময়ে ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় বিক্রি কমেছে। যান্ত্রিকীকরণে আমদানিনির্ভরতা ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রাকে ঝুঁকিতে ফেলবে কি?

কৃষিযন্ত্র বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এগুলো খুব জটিল বিষয়। একারণে দেশে এসব যন্ত্র উৎপাদন এখনই সম্ভব নয়। কারণ এখনো উৎপাদনের মতো সক্ষমতা আমাদের তৈরি হয়নি। আমরা যেটা করতে পারি, খুচরা যন্ত্রগুলো যদি নিয়ে এসে আমরা দেশে অ্যাসেম্বল করতে পারি, এতে কিছুটা সাশ্রয়ী হবে।

এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী কী?

কৃষিযন্ত্রগুলো যেহেতু আমদানিনির্ভর, সেকারণে এগুলোর অনেক দাম। শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করলে অনেকটা ভালো হয়। আবার যন্ত্র বিক্রির ওপরও শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।৫ শতাংশ কর যুক্ত হলেও যেহেতু যন্ত্রাংশগুলো অনেক দামি, তাই এর দাম অনেকটা বেড়ে যায়। আর দামের বোঝা কৃষকের ওপরই চলে যায়। কর প্রত্যাহার করতে পারলে সবার জন্য ভালো। এতে যন্ত্রাংশের ব্যবহার বাড়বে।

বাংলাদেশে কৃষির সংকট কোথায়? কীভাবে উত্তরণ করা যেতে পারে?

আমি যেহেতু যন্ত্র নিয়ে কাজ করি, তাই বলতে পারি যন্ত্রাংশে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তারপরেও যন্ত্রের যা দাম তা কৃষকরা পরিশোধ করতে পারেন না। কারণ যারা কৃষিকাজ করেন তারা দরিদ্র। আবার ট্রাক্টর কেনায় ভর্তুকি নেই। যেহেতু কৃষকদের পুঁজি নেই, তাই তারা সেটা কিনতে পারেন না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরাই কিন্তু কৃষককে ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কৃষিযন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে কৃষককে যদি কৃষি যন্ত্রাংশ কেনায় ব্যাংক থেকে লোন দেয়া হয়, তাহলে কৃষকরা লাভবান হবেন। ব্যাংকগুলো কিন্তু কৃষিযন্ত্র ক্রয়ে কোনো ঋণ দেয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণে একটি লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেয়া হয়। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোন দেয়। কিন্তু কৃষিযন্ত্রে কোনো লোন নেই। এক্ষেত্রে ঋণ দেয়া হলে যন্ত্রের প্রসার ঘটবে। যেহেতু কৃষক কমে যাচ্ছে, তাই কৃষিযন্ত্রের প্রসারের বিকল্প নেই।

দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কৃষি যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন করলেও বিনিয়োগের অভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে না। দেশে উদ্ভাবিত কৃষিযন্ত্রের সম্প্রসারণে আপনার প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করবে কি?

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) অনেক কৃষি যন্ত্র উদ্ভাবন করছে। কিন্তু প্রচারের অভাবে সেগুলোর সম্প্রসারণ হচ্ছে না। তারা যদি বেসরকারি খাতকে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যুক্ত না করে, তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। ব্রি কম্বাইন হারভেস্টার উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে তার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। তারা যদি বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে, আমরা প্রস্তুত রয়েছি। যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। সারাবিশ্বেই ব্যবসা করে বেসরকারি খাত। এখানে বেসরকারি খাতকেই এগিয়ে আসতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন