প্রযুক্তিপণ্যের ওপর করারোপে দেশ ই-বর্জ্যের খনিতে পরিণত হচ্ছে

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম , ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড

সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পের কথা বলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

স্মার্ট বাংলাদেশ অনেক বড় ধারণা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের শতভাগ অটোমেশনে যেতে হবে। কার্বন নেগেটিভ কতটুকু আছে তাও দেখতে হবে। স্মার্ট সোসাইটি করতে চাইলে সমাজে স্মার্ট সোসাইটির সব ধরনের উপাদান, সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। এর জন্য আমাদের অনেক কাজ বাকি। টিকেটিং ফেয়ার অটোমেশন, রোড টোল অটোমেশন, সার্ভিল্যান্স অটোমেশনসহ সব ম্যানুয়াল কাজকে অটোমেশনে রূপান্তর করতে হবে। এখনো সরকারি বেসরকারি সব দপ্তরেই অনেক অটোমেশন বাকি।

স্মার্ট মানেই হচ্ছে আরো বেশি দক্ষ করা। সর্বনিম্ন সম্ভাব্য সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফল বের করে নিয়ে আসাকে আমরা স্মার্টনেস বলব। আমাদের প্রতিটি ধাপ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। শতভাগ কম্পিউটারাইজেশন করতে হবে। প্রত্যেক জায়গায় অ্যাপসকেন্দ্রিক কার্যক্রম চালু করতে হবে। শুধু ফ্রন্টে একটা ওয়েবসাইট দিয়ে কাজ করলাম কিন্তু ভ্যাকেন্টে অনেক কিছুই ম্যানুয়াল থাকল, তাহলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।

আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন আনা দরকার। স্মার্ট বাংলাদেশের অংশীদার যারা হবে তারা যদি স্মার্ট না হয়, তাহলে দেশটাই আর স্মার্ট হবে না। আমাদের গ্রামীণ জীবনে আরো বেশি নজর দিতে হবে। শিক্ষার নানা পর্যায়ে বিস্তর বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। সরকারের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আমাদের প্রতিটা উপাদান এমনভাবে সংযুক্ত হতে হবে, যাতে আমরা সর্বনিম্ন সময়ে সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করতে পারি। একটা কাজ করতে গেলে যদি নানা ধরনের বাধা, প্রতিবন্ধকতা নির্ভরতা থাকে, তাহলে আমাদের তুলনামূলক বেশি সময় ব্যয় হবে।

এমনকি সরকারকেও নানা ধরনের প্রণোদনা বন্ধ করে দিতে হবে। সরকার এরই মধ্যে নানা প্রণোদনা কমিয়ে দেয়া শুরু করেছে।

সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য। আজ ডলারের সংকটে আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের রফতানির চাইতে আমদানি বেশি। আমরা নিজেরা খাতগুলোর উন্নয়ন করতে পারছি না। সারা জীবন প্রণোদনা দেয়ার উৎসাহ সরকার কোথায় পাবে? সারা জীবন প্রণোদনা দেয়াও প্র্যাকটিক্যাল না। তাহলে সরকারের কম্পোনেন্টগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। আমরা যা রেভিনিউ দেব, তার চেয়ে বেশি চাইলে তো সরকার ব্যালান্স রাখতে পারবে না। এজন্য আমাদের যেমন সমন্বয় থাকতে হবে, তেমনি কাজ করতে হবে।

একটা জায়গায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রণোদনা দিয়ে তা তুলে দিতে হবে। তা না হলে সমন্বয়হীনতা এবং নিজেদের উন্নত করার জায়গা থেকে সরে যেতে হবে। সরকারকে সারা জীবন প্রণোদনা দিতে হবে, তা আমি সমর্থন করি না।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিদ্যমান বরাদ্দে কেমন পরিবর্তন চান?

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। না হলে পরিপূর্ণভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যাবে না। আমাদের সব খাতে নজর দিতে হবে। কোন খাতে বিনিয়োগ করলে দেশের সম্পদ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়, তাতে জোর দিতে হবে। সব খাতেই সরকার বিনিয়োগ করছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সেখানে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে। তার পরও আমাদের দাবি, খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত।

ম্যান বিহাইন্ড দ্য মেশিন যদি স্মার্ট না হয়, তাহলে মেশিন স্মার্ট করে আমাদের পক্ষে চলা সম্ভব হবে না। এখানে অটোমোবাইলের প্রতি যেমন জোর দিতে হবে, একইভাবে আইটি আইটি ওরিয়েন্টেড পণ্যের ওপরও জোর দিতে হবে। প্রযুক্তি খাতে যতটুকু মাইলস্টোন তৈরি করা গেছে, তাতে আরো বেশি জোর দেয়ার জন্য বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে, বাজেট বাড়াতে হবে।

স্থানীয় সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তিনির্ভর সেবা ব্যবসার ওপর মূল্যসংযোজন করারোপ করার বিষয়ে আপনার মতামত কী?

স্থানীয় বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে দেখবেন, যত বেশি নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করা যায়, তত বেশি আমরা নিরাপদ থাকব। বিদেশী সফটওয়্যার আমদানি করলে তাদের পে করতে হচ্ছে। একটা সফটওয়্যারের মধ্যে ব্যয় হয়েছে মেধা দক্ষতা। আমরা স্থানীয় সফটওয়্যার শিল্পকে যদি কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করি তাহলে আমরা স্থানীয় সম্পদ নষ্ট করলাম এবং এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলাম না। একই সঙ্গে এর বিপরীতে একটা সফটওয়্যার আমদানি করে ডলার ব্যয় করলাম। আমাদের কাছে প্রতিটি ডলারই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের ডলার আসে বাইরে থেকে ইট ভেঙে, শ্রমিকের ঘাম দিয়ে। সফটওয়্যার লাইসেন্সিংয়ের ফি বেশি দিতে হলে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য আমরা অ্যাফোর্ট করতে পারব না। সেজন্য লোকাল সফটওয়্যারকে যত বেশি সুবিধা দেয়া সম্ভব তা দিতে হবে। লোকাল সফটওয়্যারের ওপর ভ্যাট জরুরি নয়। কারণ এখানে যে ভ্যালু এডিশন পাওয়া যাচ্ছে তাতে সরকারেরও লাভ, উদ্যোক্তাদেরও লাভ। সেখানে ভ্যাট দিয়ে যদি খাতকে সামান্যতম বাধাগ্রস্ত করা হয় অথবা আমরা যদি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাই, তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্যই ক্ষতিকর। সফটওয়্যার এবং আইটি সার্ভিসে ভ্যাট থাকা উদ্যোক্তাদের জন্য একটা বাধা। সেজন্য আমরা দাবি করছি, যদি কোনো ধরনের ভ্যাট, ট্যাক্স থাকে তাহলে তা উঠিয়ে দেয়া উচিত।

প্রযুক্তি খাতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কম্পিউটার, প্রিন্টার, টোনার ইত্যাদি। দ্রব্যগুলোর ওপর গত বছর কর আরোপ করা হয়েছে। বাজারে এর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

ল্যাপটপের ওপর করারোপের ফলে মার্কেটে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। একে তো ডলার ক্রাইসিসের কারণে ল্যাপটপের দাম বেড়ে গেছে। তার ওপর ১৬ শতাংশ করারোপের কারণে আরেকটি চাপ তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ৪০-৫০ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। সুযোগে বাংলাদেশে -বর্জ্য আসা শুরু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই পুরনো ল্যাপটপ, পুরনো সব পণ্য আনা হয়েছে। বাজারে মানহীন নকল পণ্যের ছড়াছড়ি। কর বৃদ্ধির কারণে সরকারের যে রেভিনিউ পাওয়ার কথা ছিল, তা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আগে ১৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি থাকার পর সরকার যে পরিমাণ কাস্টমস ডিউটি পেত, তার অর্ধেকও পাচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। পুরো বাজার চলে গেছে কালোবাজারিদের হাতে। ফলে ভয়ংকর একটা কাজ হয়েছে। আমাদের দেশ বিভিন্ন দেশের -বর্জ্যের খনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

কিছু কালোবাজারি হাতে করে -বর্জ্য নিয়ে আসছে এবং গ্রাহককে এসব বর্জ্য সরবরাহ করছে। দেশ থেকে টাকা ঠিকই বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা ফল পাচ্ছি না। সেজন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ, জায়গায় ভালো করে ফোকাস করতে হবে এবং আগের ডিউটি স্ট্রাকচার রিকনসিডার করা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন