শিল্পের চাকা সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ দিতে হবে

মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার , চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড

কেমন বাজেট চান?

বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। সফল্যের সঙ্গে আমরা কভিড-১৯ সৃষ্ট মানবিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ সামাল দিয়েছি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ কভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবেই টিকে আছে। গত এক বছরে বিশ্বের শিল্পোন্নত অনেক দেশের অর্থনীতিও ধসে গেছে। গোটা বিশ্বের অর্ধেক দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশের নামও। অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবারের বাজেট প্রণয়ন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। বাজেট প্রণয়নের সময় অভ্যন্তরীণ সমস্যা সংকটগুলোর পাশাপাশি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জও মাথায় রাখতে হবে। আশা করছি, সরকার একটি গণমুখী শিল্পবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করবে।

শিল্পবান্ধব বাজেট বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছেন?

দেশের শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ এখন তৈরি পোশাকসহ শিল্প খাতে নিয়োজিত। রফতানি আয়ের প্রায় পুরোটাই শিল্প খাত থেকে আসছে। দেশের কৃষিকে কেন্দ্র করেও এখন দেশে অনেক ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। সরকার কয়েক দফায় গ্যাস, জ্বালানি তেল বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। প্রয়োজন বাস্তবতার নিরিখেই হয়তো বাড়ানোর প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু দাম বাড়ার পরও দেশের শিল্প-কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। কারণে দেশের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন সচল থাকলেও অনেক কারখানার সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহূত হচ্ছে না। অবস্থায় শিল্পের উৎপাদন নির্বিঘ্ন রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আশা করছি, সরকার বাজেটে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখবে।

দেশের শিল্প খাত ব্যাংকঋণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আপনি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি খাতের উদ্যোক্তাদেরও নেতা। আবার শিল্প উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী হিসেবেও আপনার বিপুল পরিচিতি রয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতি অভাবনীয় উন্নতি করেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বাংলাদেশ এখন অনেকটাই শিল্পনির্ভর। করোনাভাইরাসের দুর্যোগেও বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য দক্ষ নেতৃত্বে এটি সম্ভব হয়েছে। তবে কভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগের ক্ষত এখনো দৃশ্যমান।

করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে। এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পণ্যবাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নতুন সংকট তৈরি করেছে। বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। শিল্পের কাঁচামালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। দ্বিগুণ হয়েছে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও। পরিস্থিতিতে সত্যিকারের ব্যবসায়ীদের জন্যও মুনাফা করা কঠিন। কভিডের সময় ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধে ছাড় পেয়েছিলেন। নীতি ছাড় উঠে যাওয়ার পর অনেকের পক্ষেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ কষ্টকর হচ্ছে। অবস্থায় ব্যাংকের দিকটিও দেখতে হবে। যথাসময়ে ঋণ ফিরে না এলে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির অবনতি হবে। আবার ব্যবসায়ীরা খেলাপি হয়ে গেলে শিল্পের উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাবে। পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে হলে ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের শিল্পকে বাঁচাতে হবে। কর ব্যবস্থাকে সর্বজনীন করে গড়ে তুলতে হবে।

অনেক দিন থেকেই আপনারা ব্যাংকের করপোরেট করহার কমানোর দাবি তুলছেন। এবারের বাজেটেও কি একই দাবি জানাচ্ছেন?

বাংলাদেশের ব্যাংকের করপোরেট করহার প্রতিবেশী কোনো দেশের সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ নয়। বিশ্বে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কর আর কোনো দেশের ব্যাংক থেকে আদায় করা হয়, সেটি আমার জানা নেই। আমরা বহুদিন থেকেই ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবি জানাচ্ছি। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করহার কিছুটা কমিয়েছে। তার পরও এখনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করহার ৩৭ দশমিক শতাংশ। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় করহার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছর আমরা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ করেছি। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় যে পরিমাণ বেড়েছে, তাতে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করা সম্ভব হচ্ছে না। খেলাপি ঋণের উচ্চহারের কারণে ব্যাংকগুলো এমনিতেই প্রত্যাশা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারছে না। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারদরই সবচেয়ে বেশি অবমূল্যায়িত। শেয়ারহোল্ডারদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ডিভিডেন্ড দিতে না পারায় ব্যাংকের শেয়ারদর বাড়ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে করপোরেট কর না কমালে অনেক ব্যাংকই নিট মুনাফায় থাকতে পারবে না। এজন্য ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবিটি এবার আরো বেশি জোরালো হয়েছে। এটি মনে রাখতে হবে, ব্যাংক না বাঁচলে অর্থনীতিও বাঁচবে না। তবে শুধু ব্যাংক নয়, এবারের বাজেটে আমরা শিল্পসহ সব খাতের কর কমানোর দাবি করছি। শিল্প-কারখানার মালিকরা বিভিন্নমুখী সংকটের মধ্যে রয়েছে। অবস্থায় করছাড় না দিলে অনেকের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা কমেনি। ডলারের সংকটও তীব্র। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি হ্রাসের নীতিতে চলছে।  সংকট কাটাতে বাজাটে কী প্রত্যাশা করছেন?

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো আমদানিনির্ভর। জ্বালানি তেল থেকে শুরু করে চাল, ডাল, গম, ভোজ্যতেল, চিনি থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই আমাদের আমদানি করতে হয়। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। কারণে আমদানিনির্ভর প্রতিটি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কীভাবে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা যায়, সে বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দরকার। আশা করছি, সরকার বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেবে। দেশের ব্যাংক খাতেই প্রতি ডলারের বিনিময় হার এখন ১০৮ টাকা। এক বছর আগে এটি ছিল ৮৬ টাকার মধ্যে। ডলারের চাহিদা জোগানের মধ্যে ভারসাম্য না ফিরলে টাকার আরো অবমূল্যায়ন হবে। এতে অর্থনৈতিক চাপ আরো বেশি গভীর হবে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি খাত যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।               

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন