সাশ্রয়ী আবাসনকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা থাকা উচিত

নাসিমুল বাতেন ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি গত বছরের জানুয়ারি থেকে দেশের আবাসন খাতের শীর্ষ ঋণদাতা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। আবাসন খাতের অর্থায়ন আবাসন শিল্পে তার দুই দশকের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশের এনবিএফআই খাতের সার্বিক অবস্থা বাজেটে খাতের প্রত্যাশার নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি তিনি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা কি? আপনারা কেমন বাজেট চাইছেন?

আমরা সবাই একটি কঠিন সময় পার করছি। আমরা দুটি জিনিসের জন্য অপেক্ষা করছি। একটি হচ্ছে জাতীয় বাজেট এবং আরেকটি মুদ্রানীতি। যেহেতু আমরা বিশেষায়িত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আবাসন খাত নিয়ে কাজ করি। তাই বিষয়টি নিয়েই আমি কথা বলতে চাই। আমাদের এখানে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে সমাজের বিত্তশালীরাই অ্যাপার্টমেন্ট কিনে বা বাড়ি কিনে। কারণে দেখা যায় বছর বছর বাজেটে তাদের ওপর নতুন করের বোঝা বাড়ে কিংবা আগে যে সুবিধাগুলো ছিল সেগুলো প্রত্যাহারের প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা যে সমাজে শুধু বিত্তশালীদের বাড়ি থাকবে আর অন্যরা ভাড়া থাকবে। ধারণা পৃথিবীর আর কোথাও কাজ করে না। বাড়ির মালিকানা পৃথিবীর সব দেশেই অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। একটি অর্থনীতি কতটুকু ভালো করছে সেটির একটি নির্দেশক হচ্ছে নতুন কতগুলো বাড়ির মালিকানা তৈরি হয়েছে। আমাদের মর্টগেজ টু জিডিপি রেশিও বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। আমাদের এখানে বর্তমানে এটি দশমিক ৭১ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে এটি ৪০-৬০ শতাংশ। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতে পাঁচ বছর আগে এটি দশমিক শতাংশ ছিল, যা বর্তমানে বেড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূলত বেশকিছু পদক্ষেপের কারণেই কিন্তু সেখানে এটি বেড়েছে। এসব পদক্ষেপ মূলত করসংক্রান্ত। আমাদের এখানে যারা গৃহঋণ নিয়ে বাড়ি করেন, তারা সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। নিজের পুরো সক্ষমতা না থাকার কারণে তারা আর্থিক সহায়তা নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেন। ধরনের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রাহককে উৎসাহিত করার জন্য কর সুবিধা দেয়া হয়। আমাদের দেশেও ধরনের সুবিধা ছিল। ২০১২ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে আপনি যখন আয়কর রিটার্ন দাখিল করতেন তখন ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ থাকলে এবং এর ওপর আপনি যে সুদ প্রদান করতেন সেটা করযোগ্য আয় থেকে বাদ দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখানো যেত। এতে গ্রাহকের কর তুলনামূলক কম আসত। ২০১২ সালে এসে আমাদের এখানে এটি প্রত্যাহার করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ধরনের সুযোগ রয়েছে। ভারতে লাখ রুপি পর্যন্ত সুবিধা পাওয়া যায়। এর যাতে অপব্যবহার না হয় এজন্য টাকার পরিমাণ কম নির্ধারণ করা হয়। যার - কোটি টাকা ঋণ তার হয়তো সুবিধার প্রয়োজন নেই বা সরকারের ভর্তুকি দেয়ার দরকার নেই।

আরেকটি বিষয়, আমাদের এখানে সম্পত্তির নিবন্ধন হার অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এর পরিমাণ সম্পত্তির মোট মূল্যের সাড়ে ১১-১৩ শতাংশ পর্যন্ত। এত উচ্চনিবন্ধন হারের কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কম দামে সম্পত্তি নিবন্ধন করা হচ্ছে। এর ফলে অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ তৈরি হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে দেখা যাচ্ছে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার জন্য কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। ফলে এখানে করের ক্ষেত্রে একটি অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে। আমরা সিস্টেমেটিক্যালি অপ্রদর্শিত অর্থ তৈরি করছি আবার সেটিকে বৈধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছি। এটিকে যদি যৌক্তিকীকরণ করা যেত এবং সঠিক মূল্যে নিবন্ধন করা সম্ভব হতো তাহলে কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ত।

ভারতে সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করতে বাজেটের মাধ্যমে বেশকিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে। যেমন যেসব ডেভেলপার সাশ্রয়ী আসাবন তৈরি করবেন তাদের আয়ের ওপর কর ছাড় সুবিধা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহকের ক্ষেত্রে আবাসন ঋণের সুদের ওপর ছাড় দেয়া হয়েছে। ছাড় তিনি একবারেই পেয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া নারীদের জন্যও প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে। কারণেই কিন্তু গত পাঁচ বছরে ভারতে মর্টগেজ টু জিডিপি রেশিও বেড়েছে। আমরা বর্তমানে একটি ক্রান্তিকালীন সময় পার করছি। আমি বলছি না যে এবারের বাজেটেই সব সুবিধা দিতে হবে। তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা শুরু করা যেতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সাশ্রয়ী সবুজ আবাসনের ক্ষেত্রে একটি পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালুর ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে সবুজ আবাসনের পাশাপাশি যারা সাশ্রয়ী আবাসন নিয়ে কাজ করবেন তাদের জন্য ধরনের তহবিল চালু করা যেতে পারে।

এর বাইরে বাজেটে আর কী ধরনের নীতিগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করছেন?

পৃথিবী বর্তমানে যে সমস্যা ভোগ করছে সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সীমিত আয়ের মানুষ যারা তাদের জন্য এটি আরো বেশি প্রযোজ্য। আমরা আশা করব, এবারের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হবে। গত কয়েক বছরে করপোরেট খাতের কর কমানো হয়েছে। তবে টেলিযোগাযোগ আর্থিক খাতের করহারে পরিবর্তন হয়নি। আর্থিক খাতের মধ্যে ব্যাংক এনবিএফআই রয়েছে। তবে ব্যবসার মডেল কার্যক্রমের দিক দিয়ে ব্যাংক এনবিএফআইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংকের তুলনায় এনবিএফআইয়ের মুনাফার পরিমাণ বেশ কম। ফলে এনবিএফআইগুলোর জন্য সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে কর প্রদান করা কঠিন। আমাদের পাশের দেশেও কিন্তু হাউজিং ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান, এনবিএফআই, ব্যাংক প্রত্যেকের জন্য আলাদা করহার নির্ধারণ করা আছে। আমাদের এখানে এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।

বর্তমানে এনবিএফআই খাতের ব্যবসা কেমন যাচ্ছে?

১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরুর পর গত ২৫ বছর ধরে আমরা গৃহঋণ দিয়ে যাচ্ছি। আমরা দেখেছি, তারল্য পরিস্থিতি সব সময় এক রকম থাকে না। কখনো তহবিল ব্যয় বেড়ে যায়, আবার কখনো বাজারে বেশ তারল্য থাকে। কভিডের পর কিন্তু বাংলাদেশের সব খাতই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই পরিস্থিতি কিছুটা জটিল আকার ধারণ করতে থাকে। পরিস্থিতিতে আমাদের তহবিল ব্যয় বেশ বেড়ে গেছে। আগে আমরা সাড়ে - শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ করে থেকে সাড়ে শতাংশ হারে ঋণ দিতে পারতাম। এতে আমাদের প্রায় শতাংশের মতো স্প্রেড থাকত। কিন্তু এখন আমানত সংগ্রহের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে আমরা গ্রাহকদের সাড়ে কিংবা ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছি। তবে ঋণের সুদের হার বাড়লেও আমাদের স্প্রেড কিন্তু কমে গেছে। এতে সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরই বছরের প্রথম প্রান্তিকে সুদ আয়ের তুলনায় সুদ ব্যয় বেড়ে গেছে। তবে আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন যে সামনের মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিয়মহার সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। এতে আগামী জুলাইয়ের পর থেকে আমাদের স্প্রেডের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা করছি।

বিনিময়হার সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলে এর প্রভাব কি হবে?

এগুলো আমাদের এখানে আগেও বাজারনির্ভর ছিল। সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বেশি দিন হয়নি ২০২০ সালে। যখন বাজারভিত্তিক ছিল তখন যে সুদের হার লাগামহীন হয়ে গিয়েছিল তা নয়। তাছাড়া বাজারভিত্তিক হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে সবসময় নিয়ন্ত্রণের কিছু ব্যবস্থা থাকবে। ফলে এটি যে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবে এমন নয়। বাজারভিত্তিক করে দিলেই যে একেবারে অনেক বেড়ে যাবে বিষয়টি তা নয়। তবে হ্যাঁ এখানে ওঠানামা থাকাটায় স্বাভাবিক। আরোপিত কোনো কিছু দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না।

বছরের বাকি সময়টা কেমন যাবে বলে মনে করছেন?

বছর আমাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ বছর। বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় যায় সেদিকে সবার নজর থাকবে। নির্বাচনের বছরে অনেক সময় ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা  আবাসন খাতে খুব একটা চাঙ্গা ভাব থাকে না। কিছুটা দেখে চলার প্রবণতা কাজ করে। তবে বছরের বাকি সময়টা মূল্যস্ফীতি কিংবা সুদের হারের কথা যদি বলি তাতে মনে হয় না যে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হবে। সার্বিকভাবে বছরটা একটু শ্লথ যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন