দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতে ১৭ বছর ধরে কাজ করছেন মো. কায়সার হামিদ। তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) নির্বাহী কমিটির সদস্য। এছাড়া তিনি বর্তমানে এনবিএফআইগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) ভাইস চেয়ারম্যান। সম্প্রতি তিনি দেশের এনবিএফআই খাতের সার্বিক অবস্থা ও আগামী অর্থবছরের বাজেটকে ঘিরে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেহেদী হাসান রাহাত
বর্তমানে দেশের
সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একটি
সংকটময় মুহূর্ত পার করছে।
এবারের বাজেট
নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা কী
জানতে চাই?
বাংলাদেশের ইতিহাসের
সবচেয়ে বড়
বাজেট জুনের
১ তারিখে
উপস্থাপিত হতে
যাচ্ছে। সরকার
এখানে দুটি
বিষয় মাথায়
রেখেছে, যেটা
আমরা এরই
মধ্যে প্রকাশিত
তথ্যের বরাতে
বুঝতে পারি।
একটি হচ্ছে
কৃচ্ছ্রসাধন করা।
অপ্রয়োজনীয় ব্যয়
কিংবা প্রকল্প
যেগুলো রয়েছে,
সেগুলো কমিয়ে
আনা কিংবা
না করা।
অন্যদিকে বার্ষিক
উন্নয়ন কর্মসূচির
(এডিপি) আকারকে
বড় করে
দেশের চলমান
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে
ত্বরান্বিত করা।
একটি অর্জনযোগ্য
ও উচ্চাভিলাষী
জিডিপি প্রবৃদ্ধির
লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি
মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে
নিয়ে আসা।
এ রকম
কয়েকটি বড়
ধরনের লক্ষ্যকে
সামনে রেখে
এবারের বাজেট
উপস্থাপিত হতে
যাচ্ছে। সারা
বিশ্বের অর্থনীতি
একটি চাপের
মধ্য দিয়ে
যাচ্ছে। বাংলাদেশও
এর ব্যতিক্রম
নয়। কভিডের
পরে রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক
বাজারে জ্বালানি
তেলের দাম
বেড়ে যাওয়া,
স্থানীয় মুদ্রার
অবমূল্যায়ন আমাদের
নতুন করে
চাপের মুখে
ফেলেছে। ফলে
মানুষের জীবনযাত্রার
ব্যয় যে
পরিমাণে বেড়েছে,
টাকার মূল্য
কমে যাওয়া
ও আমদানি
ব্যয় বাড়ার
কারণে তাদের
জীবনে যে
প্রভাব পড়েছে,
সেটি কিন্তু
চিন্তার বিষয়।
আমাদের প্রত্যাশা
যদি বলি
তাহলে ক্ষুদ্র
সঞ্চয়কারী যারা
রয়েছেন, তাদের
জন্য বাজেটে
একটি বার্তা
থাকা দরকার।
যুক্তরাজ্যের নতুন
প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায়
আসার পরে
যে বাজেট
দিয়েছেন, তাতে
ক্ষুদ্র ও
মধ্যম আয়ের
মানুষকে বিভিন্ন
ধরনের ছাড়
দেয়া হয়েছে।
যারা উচ্চ
আয়ের মানুষ
তাদের জন্য
আলাদা করহার
নির্ধারণ করা
হয়েছে। আমাদেরও
বিষয়টি একটু
ভাবতে হবে।
যারা ক্ষুদ্র
সঞ্চয়কারী, নিম্ন
আয়ের মানুষ,
প্রান্তিক ব্যবসায়ী,
তাদের জন্য
বাজেটে যদি
নতুন কিছু
থাকে, তাহলে
এটি জনবান্ধব
বাজেট হবে।
ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী
যাদের ৫
লাখ টাকা
পর্যন্ত আমানত
রয়েছে, তাদের
আয়কে যদি
করমুক্ত রাখা
যায়, তাহলে
সেটি তাদের
জন্য স্বস্তিদায়ক
হবে। ব্যাংক
ও আর্থিক
প্রতিষ্ঠানে ৬০
হাজার টাকা
পর্যন্ত ডিপিএসের
ক্ষেত্রে করছাড়
সুবিধা রয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায়
এটিকে ১
লাখ ২০
হাজার টাকা
নির্ধারণের প্রস্তাব
করছি। সঞ্চয়পত্রে
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে
যেমন কর
ছাড় সুবিধা
রয়েছে, একইভাবে
ব্যাংক ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
আমানতকারীদের জন্যও
একই সুবিধা
থাকা উচিত।
বেশ কয়েক
বছর ধরেই
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো
সংকটের মধ্য
দিয়ে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে আমাদের
বৈচিত্র্যময় আমানত
সংগ্রহের পাশাপাশি
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা
কাঠামোয় যাতে
ঝুঁকি চিহ্নিত
করা যায়,
সে উদ্যোগ
নিতে হবে।
এটি করতে
হলে আমাদের
ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের
কাছে যেতে
হবে। সঞ্চয়কারীদের
উৎসাহিত করতে
বাজেটে এ
ধরনের কিছু
দেখতে পেলে
আমরা তারল্য
সংকট অনেকখানি
কাটিয়ে উঠতে
সক্ষম হব।
প্রতি বছরই
বিভিন্ন খাত
থেকে সরকারের কাছে বাজেট
প্রস্তাবনা দেয়া
হয়ে থাকে।
এবারের বাজেটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল দাবিগুলো কী ?
আর্থিক প্রতিষ্ঠান
ও ব্যাংকের
ক্ষেত্রে করের
হার একই।
ব্যাংকের তুলনায়
আমাদের ব্যবসার
সুযোগ কম।
আমরা চলতি
হিসাব খুলতে
পারি না,
আমরা বৈদেশিক
মুদ্রার লেনদেন
করতে পারি
না, স্বল্প
ব্যয়ের তহবিল
উৎস নেই,
আমাদের শাখা
দেশব্যাপী সেভাবে
নেই। তাই
ব্যাংক ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
করহার আলাদা
হওয়া উচিত।
বিদ্যমান করদাতাদের
ওপর করের
বোঝা না
বাড়িয়ে কর
জাল সম্প্রসারণ
করতে হবে।
মাত্র ৫
লাখ টাকা
ঋণ নিলে
টিআইএন নেয়ার
বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
একই পরিমাণ
ঋণ এনজিও,
ক্ষুদ্র ঋণদাতা
প্রতিষ্ঠান কিংবা
সমবায় সমিতির
কাছ থেকে
নিলে কিন্তু
টিআইএন লাগছে
না। এক্ষেত্রে
কেন আমরা
২৫ লাখ
টাকা পর্যন্ত
ঋণের ক্ষেত্রে
এ বাধ্যবাধকতায়
ছাড় দিব
না যদি
আমরা সিএমএসএমই
খাতকে সহায়তা
করতে চাই।
আপনি ভোক্তা
ঋণের ক্ষেত্রে
কড়াকড়ি করতে
পারেন। কিন্তু
ক্ষুদ্র ও
মাঝারি শিল্পের
উদ্যোক্তাদের জন্য
এ বছরের
বাজেটে ২৫
লাখ টাকা
পর্যন্ত ঋণের
ক্ষেত্রে টিআইএন
বাধ্যতামূলক না
করা ও
তাদের জন্য
স্বতন্ত্র কর
নির্ধারণ করা,
এনবিএফআইয়ের জন্য
আলাদা কর
নির্ধারণ করা
এবং ক্ষুদ্র
সঞ্চয়কারীদের উৎসাহিত
করতে উদ্যোগ
নেয়ার মতো
বিষয়গুলো এবারের
বাজেটে বিবেচনা
করা প্রয়োজন।
সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে এনবিএফআইগুলো পুঁজিবাজারভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এক্ষেত্রে আপনারা বাজেটে কোনো
কর ছাড়
প্রত্যাশা করছেন
কি?
এক্ষেত্রেও আমাদের
চ্যালেঞ্জ আছে।
সাবসিডিয়ারি আয়
মূল কোম্পানিতে
লভ্যাংশ আকারে
আসছে। এক্ষেত্রে
অনেক সময়
দেখা যায়
দ্বৈত কর
চলে আসছে।
এ জায়গায়
আমাদের দীর্ঘদিনের
অপ্রাপ্তি আছে।
বিষয়টি যদি
এবার এনবিআর
বিবেচনা করে
তাহলে পুঁজিবাজারে
আমাদের বিচরণটাকে
আরো শক্তিশালী
করা যায়।
এতে পোর্টফোলিও
ব্যবস্থাপনা, নতুন
আইপিও নিয়ে
আসা, লেনদেন
ও ব্যবসাকে
আরো সম্প্রসারণ
করা সম্ভব
হবে। এবার
পুঁজিবাজারে কর
ছাড়ের বিষয়ে
যে গুঞ্জন
শোনা যাচ্ছে,
সেটিকে স্পষ্ট
করে আমার
মনে হয়
আইপিও ছাড়াও
সেকেন্ডারি মার্কেটে
বিনিয়োগে যাতে
উৎসাহিত হয়,
সেটিও যাতে
থাকে এবারের
বাজেটে। পাশাপাশি
সাবসিডিয়ারির কর
হারও আলাদা
হওয়া উচিত।
গত এক
বছরে লেনদেনের
পরিমাণ যেভাবে
কমে গেছে,
সেক্ষেত্রে প্রণোদনা
দেয়ার জন্য
করের পরিমাণ
কমানো উচিত।
শুরুতে আমাদের
হাওলা বাবদ
কর দিয়ে
দিতে হয়।
এ জায়গায়
কর হার
কমিয়ে যদি
লেনদেনের পরিমাণ
বাড়ানো যায়,
তাহলে সরকারের
রাজস্ব আয়ও
বাড়বে, পাশাপাশি
মানুষও কিছুটা
স্বস্তি পাবে।
বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ
করার সুযোগ
চান কি?
কোন খাতে
এ সুযোগ
দেয়া হলে
অর্থনীতির জন্য
ভালো হবে
বলে মনে
করেন?
অপ্রদর্শিত অর্থ
আমাদের দেশের
অর্থনীতিতে একটি
বাস্তব ইস্যু।
এটি আমাদের
মেনে নিতে
হবে। কিন্তু
এর জন্য
যদি আজীবন
সুযোগ দেয়া
হয়, তাহলে
বৈধ করদাতাদের
জন্য এটি
হতাশাজনক। সুতরাং
এটি দীর্ঘমেয়াদে
চলতে পারে
না। কিন্তু
এটিকে যদি
আপনি কার্যকর
একটি মডেলের
মধ্যে সুযোগ
করে না
দেন, তাহলে
আপনি বছরের
পর বছর
সুযোগ দিলেও
খুব বেশি
অর্থ বৈধ
হবে না।
এক্ষেত্রে একটি
নির্দিষ্ট মেয়াদে
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের
সুযোগ দেয়া
যেতে পারে।
তবে ভবিষ্যতে
কোনো কর্তৃপক্ষ
এক্ষেত্রে প্রশ্ন
করবে না,
এটিও নিশ্চিত
করতে হবে।
পাশাপাশি একটি
নির্দিষ্ট সময়সীমা
উল্লেখ করে
দিতে হবে
যে এ
সময়ের পর
আর এ
সুযোগ থাকবে
না। প্রয়োজনবোধে
অর্থের পরিমাণের
ভিত্তিতে ভিন্ন
ভিন্ন কর
হার নির্ধারণ
করেও এ
সুযোগ দেয়া
যেতে পারে।
এর আগেও
পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ
করার সুযোগ
দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে
খুব বেশি
সাড়া মেলেনি?
মানুষ তো
অর্থ বৈধ
করতে গিয়ে
তার টাকা
গচ্ছা দিতে
চাইবে না।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের
ক্ষেত্রে আপনার
আস্থার যে
জায়গা, যেখানে
আপনি দীর্ঘমেয়াদে
বিনিয়োগ করবেন,
সেটি নিরাপদ
কিনা, এর
বিপরীতে আপনি
ন্যূনতম একটি
রির্টান পাবেন
কিনা, সেটিও
গুরুত্বপূর্ণ। গত
কয়েকমাস ধরে
পুঁজিবাজার নিয়ে
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে
কিছুটা আস্থার
সংকট দেখা
যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে
সুযোগটা দেয়া
হয়েছে ঠিকই,
কিন্তু এখানে
নতুন কোম্পানিকে
নিয়ে আসা,
ঘন ঘন
নীতি পরিবর্তন
না করা,
কৃত্রিমভাবে বাজারকে
নিয়ন্ত্রণ না
করে পুঁজিবাজারকে
গঠনমূলকভাবে এগিয়ে
নিয়ে যেতে
না পারলে,
আপনি যত
সুযোগই দেন
না কেন
বিনিয়োগকারীরা এখানে
আসবে না।
প্রতি বছরই
বাজেটে বেশ
বড় অংকের
ঘাটতি থাকে।
আর এ
ঘাটতি পূরণে
সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে
ঋণ নিয়ে
থাকে। এবারো
বাজেটে বড়
অংকের ঘাটতি
রয়ে যাবে।
বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
প্রতি বছরই আমাদের বড় একটি ঘাটতি বাজেট থাকে। এ বছর আমরা খুব বেশি বৈদেশিক অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগ দেখছি না। গত কয়েক বছরে এটি অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। ফলে এবারো সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হবে। এ বছর যেহেতু মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, তাই সরকার যদি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে কিছু পরিমাণ হলেও কম ঋণ নিয়ে কর, বিদেশী অর্থায়ন ও অন্যান্য জায়গা থেকে যদি অর্থের সংস্থান করতে পারে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এডিপি ও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে সেটি এ মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য কিছুটা ভালো হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতিকে ঠিক রাখা যাবে না। সরকার যদি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয় কিংবা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ায় তাহলে কিন্তু টাকা ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে চলে যাবে। এ জায়গায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা না হলে অর্থনীতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সহায়তা দেয়াটা কঠিন হয়ে যাবে।