বিজ্ঞানভিত্তিক খামার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে

মাংস প্রক্রিয়াকরণে দেশের শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটস প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। সম্প্রতি দেশের গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা, মাংস উৎপাদন  প্রক্রিয়াকরণসহ প্রাণিসম্পদ খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে বণিক বার্তা সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএম আসিফ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত বিপ্লব

বাংলাদেশে উৎপাদিত মাংস অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়ে বেশি। কিন্তু মাংসের দাম নিয়ে ভোক্তাদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে। এর কারণ কী?

বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আমাদের মাংস উপযোগী প্রাণিসম্পদের অর্ধেকই জবাই হয় কোরবানির ঈদে। যা অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো থেকে ব্যতিক্রম। আর বাকি অর্ধেক দিয়ে পুরো বছর যায়। কারণে এক্সট্রাঅর্ডিনারি উদ্ভাবন লাগবে। প্রথাগত জাত, ফার্মিং পশুখাদ্যের ব্যবস্থাপনা দিয়ে আসলে এত বড় জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সিগনিফিকেন্ট ইন্টারভেনশন।

বাংলাদেশে গরুর মাংসের উৎপাদনশীলতা অন্য দেশের চেয়ে অনেক কম। এর কারণ কী? কীভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়? মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কম উৎপাদনশীলতার প্রভাব রয়েছে কি?

প্রথাগত সিস্টেম দিয়ে আসলে চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায়, উৎপাদনশীলতার দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। কারণ তারা বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে খামার গড়ে তুলেছে। ঘাসের জাত উন্নয়ন, গরুর জাত উন্নয়ন প্রতিপালন এবং পুরো ভ্যালু চেইনকে তারা বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসরণ করে। আমেরিকায় বিভিন্ন বয়সের গরু আলাদাভাবে কাঠামো করা রয়েছে। তাদের খাদ্যও বিজ্ঞানকে অনুসরণ করে নির্বাচন হয়। এগুলো গবেষণা করেই তারা করে। আমাদের দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গবাদিপশু পালন ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এসব মাথায় রেখে দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক খামার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কম উৎপাদনশীলতার প্রভাব রয়েছে। আমাদের আবাদি জমি কম। তাই গবাদিপশুর খাবারের জমিও কমে গেছে। ফলে পশুখাদ্যের মৌলিক উপকরণগুলো আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। আমরা পশুখাদ্য তৈরি করি মূলত মাংস বৃদ্ধির জন্য। সেই সঙ্গে প্রোটিন এনার্জির কথাও বিবেচনা করা হয়। দুই- উচ্চমানের পাওয়া যায় এমন খাদ্য আমাদের দেশে নেই। আমেরিকায় আলফা আলফা নামের একটি ঘাস রয়েছে, যেটায় ১৯-২০ শতাংশ প্রোটিন পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ১৩-১৪ মেগাজুল এনার্জি পাওয়া যায়। কারণে তাদের গরু দেড় থেকে দুই হাজার কেজি ওজন হচ্ছে। আর আমরা দামি খাবার খাইয়েও ৫০০-৭০০ কেজির বেশি করতে পারি না। তাদের উন্নতি হয়েছে গবেষণার মাধ্যমে। আমাদের দেশে ধানের ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা অনেক বেড়েছে। কারণে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু প্রাণিসম্পদ খাতে এমন গবেষণা হয়নি।

মাংস প্রক্রিয়াকরণে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে?

পোলট্রির প্রক্রিয়াকরণে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। কারণে পোলট্রিতে প্রক্রিয়াকরণ ভালো এগিয়েছে। তবে গরু বা খাসির মাংসে আমাদের পরে খুব অল্প প্রতিষ্ঠান এসেছে। চাহিদার ক্ষেত্রে মানুষ এখনো কাঁচাবাজার থেকে কিনতে পছন্দ করে। এশিয়ার কয়েকটি দেশে সীমিত পরিসরে আমাদের মাংস রফতানি হয়।

প্রক্রিয়াজাত মাংস রফতানি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?

মাংসের প্রক্রিয়াকরণে অনেক ক্রাইটেরিয়া মেনে চলতে হয়। লালন-পালনের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ পশুখাদ্য ওষুধসহ ভ্যালু চেইনের প্রতিটি স্তরে সুব্যবস্থাপনা রাখতে হয়। এর জন্য অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হয়। কারণে খুব বেশি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াকরণে আসেনি। মাংসের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রক্রিয়াকরণে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অনুমোদন নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে প্রাণিসম্পদের রোগ বা মহামারির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ডের সমতূল্য নয়। একারণে বিদেশি সরকারগুলো বাংলাদেশ থেকে মাংস আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। শুধু বেঙ্গল মিটের মাংস এশিয়ার কিছু দেশে রফতানি হয়। তবে সম্ভাবনার দিক হলো পিজা বা বার্গারজাতীয় খাদ্যে যে মাংস রয়েছে, তাতে উন্নত দেশগুলোয় শ্রমিক খরচ বেশি হয়। আমাদের দেশে যেহেতু শ্রমিক খরচ কম, কারণে এখানে ভালো নজর দেয়া যেতে পারে।

খাতের উন্নয়নে এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী? মাংস উৎপাদন বৃদ্ধিতে কী ধরনের সহায়তা চান?

যেভাবে নগরায়ণ জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে প্রথাগত পদ্ধতিতে গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। আমরা কৃষি প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানিগুলোর মতো সুবিধা পাই না। বিভিন্ন দেশের কৃষির মধ্যে প্রাণিসম্পদ, শস্য সব একসঙ্গেই থাকে। কারণ খামার বলতে যেকোনো খামার হতে পারে। আমাদের দেশে এগ্রোপ্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর জন্য ১০ বছরের কর অবকাশ রয়েছে, কিন্তু মিট প্রসেসিংয়ে সেটা আমরা পাই না। আবার আমাদের যেকোনো করপোরেট রেটের মধ্যে ট্যাক্স দিতে হয়। সাপ্লাই সেলস করতে গেলেও শতাংশ পর্যন্ত অগ্রিম আয়কর দিতে হয়। অথচ আমাদের নেট মুনাফা হয় - শতাংশ। বিষয়গুলো সংশোধন করা দরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সুবিধাগুলোও আমরা পাই না। প্রাণিসম্পদসংশ্লিষ্ট পণ্যকেও কৃষিপণ্যের মতো সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা দরকার। মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ মাংস বিপণনে স্পেশালাইজড কোল্ড চেইন মাংসের নিরাপত্তা এবং পুষ্টিগুণ সংরক্ষণে মূল ভূমিকা রাখে। কোল্ড চেইনের যন্ত্রাদি আমদানি নির্ভর। এগুলো উচ্চহারে শুল্কায়িত। মাংস প্রক্রিয়াজাতকারী শিল্পের ওপর আমদানি শুল্ক রদ করা নিরাপদ মাংস সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আবার সরকার যেভাবে সারে ভর্তুকি দেয়, সেভাবে প্রাণিখাদ্যেও ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে।

মাংস উৎপাদন খরচ কমাতে কোনো নীতিসহায়তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি?

প্রথমত, সরকারকে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করতে হলে গবাদিপশুর উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য পশুপালনে বিজ্ঞানভিত্তিক ফার্মিং দরকার। সরকারকে এখানে গবেষণায় বরাদ্দ দিতে হবে এবং সেটার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যারা এখন কাজ করছে তাদের নিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ঘাস উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণার দরকার রয়েছে। দেশী গরুর জাতকে উন্নয়ন করা না গেলে সংকরায়ণের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো দরকার। নিরাপদ মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা কর অবকাশ পাই না। এক্ষেত্রে সরকারের নজর দেয়া দরকার।

একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য দেশীয় জাতের সংরক্ষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বাণিজ্যিক খামারে বিদেশী জাতের গরুও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে করণীয় কী?

অবশ্যই দেশী জাতকে সংরক্ষণ করতে হবে। আবার দেশী জাতে যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নত করতে হবে। বিদেশী জাতই আনতে হবে এমন নয়, দেশী জাতকে বিভিন্নভাবে জেনেটিক এডিটিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। এতে দেশী গরুর সংরক্ষণও থাকবে, আবার দুর্বলতা কাটিয়ে উন্নয়নও সম্ভব হবে। সরাসরি সংকরায়ণ না করে জাত উদ্ভাবন করলেও হয়। প্রাণিসম্পদ খাতের কর্মকর্তারা বেশির ভাগ সময় প্রান্তিক চিকিৎসার পেছনেই ব্যয় করছেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে খামার ব্যবস্থাপনা ভ্যালু চেইনের উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে চিন্তা করতে হবে। চিকিৎসার জন্য ভেটেরিনারি ব্যাকগ্রাউন্ডে যারা রয়েছেন, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে। আর যারা বিসিএস থেকে এসেছেন, তারা তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় কীভাবে দীর্ঘমেয়াদে প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন করা যায়, সেদিকে বেশি নজর দিবেন।

দেশে মাংস বা পশু আমদানি নিয়ন্ত্রণে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন?

দেশে মাংস আমদানির বিরুদ্ধে দেশীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যতটা না মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার কৃষির জন্য। মনে রাখতে হবে গরু প্রতিপালন, মাংস প্রতিপালন শস্যবীজ জন্মানো এসব মিলেই খামার কৃষি। পশু প্রতিপালনের একটি বড় বিষয় হলো, এর তৈরি গোবর সার মাটির উর্বরতা বাড়াতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখছে। অতীতে কীটনাশক রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাটির ওপরের অংশের উর্বরতা অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে। এর সমাধান সবচেয়ে উপযোগী গোবর, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। এতে কৃষি লাভবান হবে। এখন যদি শুধু মাংসের দামের বিষয়টি বিবেচনা করে আমদানিকে সমর্থন করি কৃষির বিষয়টি বিবেচনা না করি, তাহলে পেশার সঙ্গে যুক্ত গ্রামীণ যুবকরা পেশা ছেড়ে দেবেন। এতে আরো বড় ঝুঁকিতে পড়তে হবে। তখন খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হবে। অস্থির বিশ্বে বিদেশ থেকে খাদ্য আনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা অতীতে আমরা দেখেছি। কারণে শুধু দামের বিষয়টি বিবেচনা করে আমদানি সমর্থন করা যাবে না। বরং বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে কীভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়, যার মাধ্যমে দাম কমে আসবে, সে বিষয়টি ভাবা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন