ফার্নিচার সেক্টরে সম্পূরক শুল্ক বাতিল করা হোক

সেলিম এইচ রহমান , চেয়ারম্যান ম্যানেজিং ডিরেক্টর, হাতিল কমপ্লেক্স লিমিটেড

বর্তমানে ফার্নিচার শিল্পের সার্বিক অবস্থা কেমন?

মুহূর্তে অনেক শিল্পই খুব কঠিন সময় পার করছে। ডলার, কাঁচামাল, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের ওপর চাপ পড়েছে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফার্নিচারের দাম বেড়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। ফলে ফার্নিচার শিল্প যে খুব ভালো করছে এমনটা বলা যাবে না। পুরো বিশ্ব একটা কঠিন সময় পার করছে। আমরা ধৈর্য ধরে আছি।

পণ্য হিসেবে ফার্নিচার মৌলিক নয়। অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার পর মানুষ এদিকে নজর দেয়। যারা ফার্নিচার কিনতেন, তারা হয়তো ফার্নিচার কেনা পিছিয়ে দিচ্ছেন। তার প্রভাব শিল্পে পড়ছে। সবাই একটু সংকুচিত হয়ে আছে।

আপনারা তো রফতানি করছেন। বৈশ্বিক বাজারে ফার্নিচার শিল্পের অবস্থান কেমন দেখছেন?

২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিগুণ ভালো বলব। দ্বিগুণের পরিমাণটা যদি অংকে বলি খুব বড় কিছু না। এখানে মূল সমস্যাটা একটু খোলাসা করে বললে আপনাদের বুঝতে সহজ হবে। আমরা ফার্নিচার এক্সপোর্ট করছি। আমাদের রিসোর্স কী? মানবসম্পদ। আমাদের একটা ওয়ার্কিং ফোর্স আছে। আর তেমন কিন্তু কিছু নেই। আমাদের কাঠ নেই। বনসম্পদ নেই। অনেক ধরনের কাঁচামাল দেশে উৎপাদন হয় না। ফলে ফার্নিচার রফতানি করতে গেলে আমাদের এসব কাঁচামাল ইমপোর্ট করতে হয়। তখন বিভিন্ন ধরনের ডিউটি, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ইত্যাদি দিতে হয়। কিছু কাঁচামাল এনে আমরা পণ্য তৈরি করে এক্সপোর্ট করি। গার্মেন্টস সেক্টরে আমরা আসলে শ্রমটাকেই এক্সপোর্ট করছি। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু গার্মেন্টস সেক্টরটা যেভাবে ফ্লারিশ হয়েছে, সরকার বা নীতিনির্ধারকরা যেভাবে চিন্তা করেছে, ফার্নিচার সেক্টরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। গার্মেন্টস শিল্পে বন্ডের ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে ম্যাটেরিয়ালস আনার সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে ডিউটি দিতে হয় না। তবে ফার্নিচার বা ধরনের কয়েকটি সেক্টরে সুবিধাগুলো নেই। বিষয়গুলো আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি। বছরের শুরুর দিকে আমরা বিডার কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আসলে ফার্নিচার সেক্টরের এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা কী? আমাদের সম্ভাবনা কী? কীভাবে আমরা এটিকে ওভারকাম করতে পারি? সে রিসার্চের সঙ্গে ফার্নিচার অ্যাসোসিয়েশন, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর মিলে একটি কমিটি করা হয়েছিল। সেখানে পুরো ব্যাপারটা উঠে এসেছে। ভিয়েতনাম এক্সপোর্টে জায়গায় আসতে পারার কারণ আমরা সেখানে দেখিয়েছি। ওখানকার সরকার কীভাবে ফার্নিচার এক্সপোর্টকে উৎসাহ করেছে তা নিয়েই একটি রিসার্চ পেপার তৈরি হয়েছে। সেটা আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়েছি। আমরা আশা করছি এর একটা প্রতিফলন দেখতে পাব। ফার্নিচার সেক্টরটা এমনই। সেখানে প্রচুর ম্যানপাওয়ার দরকার। তা বাংলাদেশের আছে। সেটা এগিয়ে নিতে পারলে আমাদের বেকারত্বের সমস্যা দূর হবে। পাশাপাশি রফতানি আয়ও বাড়বে। এজন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই ফার্নিচার খাত নিয়ে শর্টটার্ম, মিডটার্ম এবং লং টার্ম প্ল্যান করতে হবে। সেটা না হলে ফার্নিচার সেক্টর এগোবে না।

গার্মেন্টস সেক্টরের মতো ফার্নিচার খাতেও বন্ড সুবিধা দেয়ার দাবি অনেক দিনের। এটা এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কারণ কী?

এটি আমাদের উদ্যোক্তাদেরই ব্যর্থতা। আমরা আসলে সরকারকে বোঝাতে পারিনি। আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয়তো বিষয়টি নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারেননি। আমি এতটুকুই বলতে পারি।

ফার্নিচার সেক্টরের লোকাল মার্কেট কেমন?

এটার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ধারণা করছি, কেউ কেউ এটাকে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা বলে থাকেন।

ফার্নিচার সেক্টরকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গত অর্থবছরে প্রায় এক ডজন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন কি হয়েছে?

না। সেগুলোর কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। বরং গত বাজেটে সরকার যখন ডলার সংকটের কারণে ইমপোর্ট সীমাবদ্ধ করা শুরু করল, তখন আমাদের অনেক কাঁচামালের ওপর সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি এল। আমি যতটুকু জানি, এটা করা হয় লোকাল ইন্ডাস্ট্রিকে প্রটেকশন দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা এমন কিছু কাঁচামাল আনি, যা এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই বাংলাদেশে উত্পন্ন হচ্ছে না। সে ধরনের ম্যাটেরিয়ালসের ওপর সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। আমরা আবেদন করেছি, যেহেতু আমরা ম্যানুফ্যাকচার করছি, সুতরাং আমাদের ওই ধরনের ম্যাটেরিয়ালসের ওপর সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি যেন বাদ দেয়া হয়। একটা সময় ফার্নিচার বিলাসপণ্য ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। সবাই সাধ্যের মধ্যে ফার্নিচার কিনছেন। জরুরি পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক মানুষ চাকরি হারাবে। এটা আসলে আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

আসন্ন বাজেটে আপনাদের সুনির্দষ্ট দাবি কী কী?

খুব বেশি দাবি আমাদের নেই। আমরা আসলে অযৌক্তিক কোনো দাবি তুলতেও চাই না। আমাদের একটা বড় দাবি ছিল, ইন্ডাস্ট্রির জন্য সম্পূরক শুল্ক তুলে ফেলা হোক। বিশেষ করে আমাদের ট্যাক্সের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলো বছর শেষে ট্যাক্স রিফান্ড পায়। আমাদের ইমপোর্ট স্টেজে আমরা যখন বিভিন্ন প্রডাক্ট সাপ্লাই করি, অ্যাডভান্সড ইনকাম ট্যাক্স আমাদের থেকে নিয়ে নেয়া হয়। বছর শেষে অনেক কোম্পানি সরকারের কাছে ট্যাক্স রিফান্ড পায়। রিফান্ডগুলো আসলে আমরা পাচ্ছি না। ওটা শুধু জমাই থাকে। হয়তো কখনো পাব। কিন্তু এতে আমাদের কস্ট অব ক্যাপিটাল বেড়ে যাচ্ছে। টাকার ওপর ব্যাংকে ইন্টারেস্ট গুনতে হচ্ছে। আমাদের দাবি হলো এটা যেন সমন্বয় করে দেয়া হয়। এর বাইরে আমাদের আরো কিছু দাবি আছে। আমরা যারা ম্যানুফ্যাকচারার, সরকারের আদর্শ হারে যারা ভ্যাট প্রদান করে, যাদের ধরনের ডকুমেন্ট বা সবকিছু ক্লিয়ার আছে, তাদের যেন অ্যাডভান্স ট্যাক্সের বিষয়টা বিবেচনা করা হয়। কেননা, তারা সরকারের কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করে। আরেকটি বিষয় আমরা বলার চেষ্টা করেছি, আমাদের ইমপোর্ট ডিউটিটা যেন একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ডিউটি বাড়লে সেটা আলটিমেটলি ভোক্তার ওপরই গিয়ে পড়ছে। ভোক্তার জন্য এটা আসলে এখন খুব স্বস্তির জায়গায় নেই। প্রডাক্টের দাম বা সবকিছু মিলিয়ে। ব্যবসায়ী হিসেবে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। গত দশ বছরে সেক্টরটা ধাপে ধাপে অনেকটা থমকে যাওয়ার অবস্থানে চলে এসেছে। সার্বিকভাবে আমাদের কয়েকটা দাবিই জানিয়েছি।

আপনার হাতিলের আজকের সফলতার পেছনের গল্প কী?

হাতিলের জার্নি ৩০ বছর। হাতিল সবসময় ক্রেতাকে যৌক্তিক দামে ভালো কোয়ালিটির প্রডাক্ট দেয়ার চেষ্টা করে। আমরা সব সময় চেষ্টা করি আরো ভালো সার্ভিস কীভাবে দেয়া যায়। সর্বোপরি আমরা কমিটমেন্ট মেইনটেইন করার চেষ্টা করি। ফলে গত তিন দশকে অর্জিত ক্রেতাদের আস্থাই আমাদের সফলতার মূল কারণ। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন