বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বরাদ্দ আরো বাস্তবসম্মত হোক

বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে প্রতি বছর মোটা অংকের ভর্তুকি হিসেবে বরাদ্দ দেয় সরকার। ভর্তুকি হিসাব করেই মূলত বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হয়। তবে গত অর্থবছর থেকে বিপিডিবির ভর্তুকির অর্থ পেতে সমস্যা হচ্ছে। আর কারণে বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা, আইপিপিগুলোর বিদ্যুতের বিল বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া, ডলার সংকটসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। সমস্যামান এসব বিষয় সামনে রেখে এবারের বাজেটে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা পরামর্শ নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ফয়সাল খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু তাহের

২০২৩-২৪ বাজেট আসন্ন। বাজেটে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা কী?

আমাদের দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেট হোক। মূলত সরকার যে বাজেট ঘোষণা করবে, সেই বাজেট বাস্তবায়িত হতে হবে। আমরা বছরের পর বছর সরকারের বাজেট দেখি, শুনি। কিন্তু আসলে সেটি বাস্তবায়িত হয় না। সেটি প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা, সেই হিসাবনিকাশ করে দেখতে হবে। যেমন বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে আইপিপিগুলো নিয়ে এখন আমরা ভুগছি। গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সরকার যে পরিমাণ ভর্তুকি বরাদ্দ দিয়েছিল, সেই অংকের টাকা কিন্তু বিপিডিবি পায়নি। বিপিডিবি প্রতিশ্রুত টাকার অংক না পাওয়ায় তারা আইপিপিগুলোর বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ অর্থ দিতে পারছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে। অথচ গত বছরের বিদ্যুৎ খাতের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সেই অর্থ দেয়া হয়নি। পরিকল্পনা করা বাজেটের বাস্তবে সে অংকের টাকা বরাদ্দ না দেয়ায় বিপিডিপিও ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। সেজন্য বিদ্যুৎ খাতে দেয়া ভর্তুকি যথাসময়ে দেয়া জরুরি। বরাদ্দের অংকের ওপর ভিত্তি করেই বিপিডিবি আইপিপিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়।

বিদ্যুৎ খাতে মুহূর্তে আইপিপিওলোর বকেয়ার পরিমাণ কত?

বর্তমানে (২০২২-২৩ অর্থবছরের) বিপিডিবির কাছে আইপিপিগুলোর এখনো ছয় মাসের বকেয়া রয়ে গেছে, যা প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো।

আইপিপি একটি অত্যাধিক মূলধননির্ভর খাত যেখানে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের জন্য বড় অংকের সুদ গুনতে হয়। অন্যদিকে দেরিতে কিস্তি পরিশোধ করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। একদিকে টাকা-ডলারের বিনিময় হারের নেতিবাচক প্রভাব আর অন্যদিকে বিপিডিবির অতিরিক্ত বিলম্বিত বিল দুইয়ের সমন্বয়ে আইপিপি কোম্পানিগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আইপিপিগুলো অর্থবছরে হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনেছে, যা হয়তো ৫০০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ থাকত যদি বিপিডিবি সময়মতো আইপিপিদের বিল দিতে সক্ষম থাকত। আসন্ন বাজেটে চলতি বছরের বকেয়াসহ সামনের কার্যক্রম মাথায় রাখতে হবে। সে কারণে বাজেট পরিকল্পনা আর বরাদ্দে সামঞ্জস্য রাখা অপরিহার্য।

আইপিপি খাতে জ্বালানি ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ক অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় বেশি? বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচে তার প্রভাব পড়ছে। বিষয়ে আপনাদের কোনো সুপারিশ আছে কিনা?

বৈশ্বিক জ্বালানির উচ্চমূল্য আর তার সঙ্গে ডলার সংকট মিলে আইপিপিগুলোর জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনও (বিপিসি) তেল আমদানিতে এলসি খুলতে বেগ পাচ্ছে। এখানে আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা আশা করি।

এজন্য আমরা আইপিপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করছি যেন ফার্নেস অয়েল, এলএনজি এবং কয়লাএই তিন মূল জ্বালানির ওপর সমপরিমাণ, বা ২২ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে এনবিআর। বর্তমানে ফার্নেস অয়েলের ওপর আমদানি ৩৪ শতাংশ, এলএনজির ওপর ২২ শতাংশ আর কয়লার ওপর মাত্র শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক আরোপের ব্যবধানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের আসল খরচ বিকৃত হচ্ছে আর আমাদের জাতীয় সিদ্ধান্তগুলো ভুল মূল্যের ওপর নির্ণীত হচ্ছে।

সঠিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল্য জানা থাকলে আমরা ফার্নেস অয়েল, এলএনজি বা কয়লা, কোন জ্বালানিতে জাতীয় সাশ্রয় হবে তা বুঝে উৎপাদন করলে, আমাদের বাজেটের ওপর চাপ কমবে আর বিদ্যুতের যে  সংকটটা এখন হচ্ছে, সেটি অনেকাংশে কমে আসবে।

ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানি করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে এলসি জটিলতা হচ্ছে। এখানে কোনো সমাধান আছে কিনা?

ডলারের পুরো ব্যাপারটাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন। বাজেটে আমরা প্রত্যাশা করি, যেন ডলারের বিষয়টি আরো প্রাধান্য দেয়া হয়। এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা না পেলে আমরা বিদ্যুৎ নিয়ে যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি সেটা হয়তো আরো প্রকট হবে। সামনে লোডশেডিং আরো বেড়ে যাবে, অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ খুবই ভাগ্যবান যে বিশ্বে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কমে গেছে। এজন্য এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে এবং সেটি সাশ্রয়ী দামে। আমরা কেউ ভাবিনি যে এত তাড়াতাড়ি দাম কমে আসবে। এলএনজির দাম কমার কারণে আমাদের ওপর চাপটা একটু কমেছে। নীতিনির্ধারকদের বিপিডিবির বিদ্যমান বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম এবং আইপিপির বিদ্যুতের মূল্য হিসাব করে যতটুকু ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন তা পুরোটাই অর্থ বাজেটে অনুমোদন করা উচিত। 

১০ বছর আগে সরকারের বিদ্যুৎ খাত প্রথম অগ্রাধিকার ছিল। দেশে বিদ্যুৎ সক্ষমতা সমাধান হয়েছে। এখন সমস্যা সমাধান হওয়ার পর সেটি আবার নষ্ট করে ফেলা অনুচিত হবে। 

আইএমএফ থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা, দপ্তরের আর্থিক বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে। আইপিপিওলো নিয়ে আইএমএফের কোনো পযর্বেক্ষণ আছে কিনা?

আইএমএফ থেকে আইপিপি নিয়ে আমাদের জানামতে কোনো পর্যবেক্ষণ নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের ওপর কোনো প্রেসারও প্রত্যক্ষভাবে দেখিনি আমরা। তবে আইএমএফ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়ার কথা বলেছে। আমরা আশঙ্কা করছি, এক্ষেত্রে গত বছরের বাজেটে বিদ্যুতে যে পরিমাণ অনুমোদিত বাজেট ছিল, সেই অর্থ পেতে বিপিডিবির আরো সময় লাগতে পারে। বিপ্পার পক্ষ থেকে অনুরোধ জানিয়েছি এটা ছাড় দেয়ার, কারণ এটি একটি অনুমোদিত বাজেট।

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সরকারের আর্থিক সংকট দিন দিন বড় হচ্ছেবিশেষত অর্থের সংস্থান না হওয়া, বকেয়া বেড়ে যাওয়া, ডলার ঊর্ধ্বমুখিতায় আগামীতে খাতে বিনিয়োগ করতে উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন কিনা?

এমনটা না যে শুধু বিদ্যুৎ খাতেই বিনিয়োগবিমুখ হবে, পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে বাংলাদেশের বিজনেস ক্লাইমেটের সব খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত দশকে জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ খাতে হয়তো আমাদের বিনিয়োগ বেশি করেছি বলে সরকার এখন আর বিদ্যুতের অবকাঠামো নিয়ে চিন্তিত নয়। তবে অন্যান্য খাতের বিনিয়োগ চিন্তা করলে, সেখানেও কিন্তু বিনিয়োগসংক্রান্ত নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কাস্টমস থেকে পণ্য বের করে আনা যে কত বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে অসংগত এইচএস কোড দিয়ে দেয়, যার জন্য পণ্য খালাসে আমাদেরও ভোগান্তি হয়, ট্রাইব্যুনালে যেতে হয়। ফলে এটা একধরনের বিনিয়োগবিমুখতার কারণ হতে পারে।

দেশে বিনিয়োগসংক্রান্ত যেসব চুক্তি হচ্ছে, এসব চুক্তি যদি সরকার রক্ষা করতে না পারে, তাহলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কীভাবে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে? এজন্য সরকারের উচিত যে বিষয়গুলো চুক্তি হয়েছে যেমন বিদ্যুৎ সরবরাহ সেগুলোর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।

সম্প্রতি সামিটের সঙ্গে জেরার বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। চুক্তির ফলে কী, কী ধরনের জ্বালানি পণ্য আমদানি হবে?

২০১৯ সালে সামিট জেরার পার্টনারশিপ হয়। এর মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হবে সেগুলো সামিট জেরা যৌথভাবে করবে। জেরা জাপানের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ পরিষেবা কোম্পানি, একই সঙ্গে বৈশ্বিক এলএনজি আমদানির বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।

এবার (২০২৩-) জেরার সঙ্গে সামিটের  যে সমঝোতা সই হয়েছে তা মূলত বিদ্যুতের বাইরে জ্বালানি খাতের ব্যবসাকে প্রসার করার লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জ্বালানি বাণিজ্য নিয়ে সামিট জেরা একসঙ্গে কাজ করাই মূলত চুক্তির লক্ষ্য। বিশেষত এলএনজি আমদানি বাণিজ্যই চুক্তিতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটি ইতিবাচক দিক হলো তাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য চুক্তি থাকলে, আমরা সহজেই জ্বালানি আমদানিতে জাপানি অর্থায়ন পেতে পারি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন