ক্যাশবিহীন স্মার্ট ইকোনমি বাস্তবায়নে এমএফএস হবে অন্যতম মাধ্যম

কামাল কাদীর, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিকাশ

হাতের নাগালে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এমএফএস চালু করেছে বাংলাদেশ। খাত কতটা সফল বলে আপনি মনে করেন?

এক যুগ আগে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এখন দেশের আর্থিক লেনদেনের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে এবং ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেমটিকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। শুধু দৈনন্দিন লেনদেনই নয়, মানুষ এখন কোথাও না গিয়ে তার বিকাশ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লোন, সেভিংস সেবা নিতে পারছে, বিদেশে থাকা প্রবাসীরা দেশে থাকা স্বজনের কাছে মুহূর্তেই রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য মোবাইল ব্যাংক খাত একটি শক্তিশালী পেমেন্ট ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে, যাতে মানুষ তার হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ওয়ালেট থেকেই সব ধরনের কেনাকাটা করতে পারেন। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিয়ে জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করছে মোবাইল আর্থিক সেবা। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে উন্নীত হওয়ার অভিযাত্রায় সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পে ক্যাশবিহীন স্মার্ট ইকোনমি বাস্তবায়নে এমএফএস হবে অন্যতম মাধ্যম।

এমএফএস আরো সহজ নিরাপদ করতে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

এমএফএসের মাধ্যমে নিরাপদ লেনদেনে গ্রাহক সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানো গেলেই এমএফএসের ব্যবহার আরো সহজ নিরাপদ হবে। এক্ষেত্রে বিকাশ গ্রাহকের মোবাইল ব্যাংকিং নিরাপদ রাখার নিমিত্তে সারা বছরই সচেতনতামূলক ডিজিটাল লিটারেসি বিষয়ক নানা উদ্যোগ পরিপালন করে। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে যাতে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘঠিত না হয়, সে লক্ষ্যে এজেন্টদের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বিত কর্মশালা, এজেন্টদের প্রশিক্ষণ গ্রাহকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারা বছরই টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, লিফলেট, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে বিকাশ। উদ্যোগগুলোর সঙ্গে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ থেকে সমন্বিত উদ্যোগ এমএফএসের ব্যবহার আরো সহজ নিরাপদ রাখতে সহায়ক হবে।

মোবাইল ব্যাংকিং খাতে আইনি বা নীতিগত কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন কি?

সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং সহযোগিতায় মাত্র এক যুগেরও কম সময়ে এমএফএস খাত অনেকটাই বিকশিত হয়েছে। এখন সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের সঙ্গে মিলিয়ে খাতের টেকসই অবস্থান তৈরির জন্য সঠিক নির্দেশনা অব্যাহত রাখা জরুরি। খাতের আরো বিকাশে কীভাবে আরো নীতিসহায়তা দেয়া যায় তা নিয়ে সরকার সব স্টেকহোল্ডারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আরেকটা জিনিস জরুরি, সেটি হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, যাতে সবাই বিকশিত হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী সেবার মাধ্যমে ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির যাত্রাকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে।

গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা কতটুকু?

বিআইডিএসের ইমপ্যাক্ট অব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ-দ্য কেস অব বিকাশ গবেষণায় দেখা গেছে এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ এর ব্যবহারকারীদের আয় বাড়াতে সহায়তা করছে। গবেষণায় দেখা যায় দেশের বৃহত্তম এমএফএস প্রতিষ্ঠানটি পরিবার পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অভিঘাত বা সংকটের সময় ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য নারীর ক্ষমতায়নেও ভূমিকা রাখছে বিকাশ।

দেশজুড়ে লাখ ৩০ হাজার এজেন্ট নিয়ে বিকাশের রয়েছে শক্তিশালী এজেন্ট নেটওয়ার্ক। দেশের যেকোনো প্রান্তে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে গ্রাহক পেয়ে যাচ্ছেন এজেন্টদের, যারা গ্রাম শহরের মধ্যে অবাধ অথচ নিয়ন্ত্রিত অর্থ স্থানান্তরের সেবাকে নিশ্চিত করছেন। ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায় আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে শহর গ্রামের দূরত্ব ঘুচেছে, গ্রামীণ জনপদে আর্থিক গতিশীলতা এসেছে, ঘটছে সামষ্টিক উন্নয়ন।

মোবাইল ব্যাংকিং দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সহজীকরণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে?

বিকাশের ডিএনএতে সবসময়ই মূল ফোকাস ছিল ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা কিংবা সীমিত ব্যাংকিং সেবার আওতায় থাকা মানুষের জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সহজতর করা। বিকাশ সে কাজটিই করে যাচ্ছে নিবিড়ভাবে। ব্যাংকের সঙ্গে বিকাশের লেনদেনের একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম তৈরি করেছে বিকাশ। মুহূর্তে বিকাশের প্রায় সাত কোটি গ্রাহক দেশের ৪৩টি ব্যাংক থেকে অ্যাড মানি সেবা ব্যবহার করে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা আনতে পারছেন নিমিষেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ইস্যুকৃত সব ভিসা মাস্টার কার্ড থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা আনার সুযোগতো রয়েছেই। ব্যাংকিং সময়সীমার মধ্যে নির্ধারিত শাখায় গিয়ে লেনদেনের বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে গ্রাহকরা এখন প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো স্থান থেকে যেকোনো সময় বিকাশে টাকা আনতে পারছেন আবার দরকার হলে বিকাশ থেকে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়াসহ ডিপিএস, ঋণের কিস্তি ইত্যাদি নানা সেবা ঘরে বসেই নিতে পারছেন বিকাশ টু ব্যাংক-এর মাধ্যমে। দেশের প্রথম ডিজিটাল ন্যানো লোন চালু করেছে বিকাশ। গ্রাহকরা বিকাশ অ্যাপ থেকে সিটি ব্যাংকের জামানতবিহীন লোন নিতে পারছেন কোনোরকম কাগজপত্র ছাড়াই।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাসিক লেনদেন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ক্যাশলেস সোসাইটি এখন বড় বাস্তবতা। বাংলাদেশ সে যাত্রার দিকেই এগোচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে ক্যাশবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত হচ্ছে। ক্যাশলেস সোসাইটির উদাহরণ হিসেবে আমরা সুইডেনের কথা বলতে পারি। সেখানকার মানুষ এখন সম্পূর্ণ ক্যাশলেস লেনদেনে অভ্যস্ত। একই পথে হাঁটছে ফিনল্যান্ড, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

যত বেশি ডিজিটাল লেনদেন হবে, কর আদায়ের আওতা তত বড় হবে। সরকারের আয় বৃদ্ধির জন্য ডিজিটাল লেনদেন ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। খাতের মাধ্যমে ১২ বছরে সরকারের বিপুল পরিমাণ ভ্যাট এআইটি উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যে সুফল পেয়েছে, তা উত্তরোত্তর আরো বাড়বে।

বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের অন্যতম লক্ষ্য হলো ক্যাশলেস সোসাইটিতে পরিণত হওয়া। বিকাশ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য একটি স্মার্ট ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে, যাতে মানুষ ক্যাশলেস লেনদেন করতে পারেন অনায়াসে। ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ছে, তবে সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সোসাইটি হতে যেতে হবে বহুদূর।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন