বাজেটে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে

করোনা মহামারী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের বাজারে অস্থিরতা চলছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাজেটে কেমন সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন আলোচনা হচ্ছে সেটি নিয়েও। এসব বিষয়ে বণিক বার্তা সঙ্গে কথা বলেছেন স্বপ্ন সুপার মার্কেটের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন

সাধারণ মানুষের একটি অভিযোগ রয়েছে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কেনাকাটা করলে দুবার কর দিতে হয়। বিষয়টি আসলে কেমন?

উৎপাদন পর্যায়ের ভ্যাট আর বিক্রয় ভ্যাট ভিন্ন। আমার মনে হয় এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরো প্রচারণা চালানো উচিত। কর কী কী কারণে হয়, কোন পর্যায়ে কোন কর দেয়া হয় ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এনবিআর মনে করে উৎপাদন পর্যায়ে যে কর সেটা এমআরপিতে অন্তর্ভুক্ত। বিক্রয় কর ভিন্ন। এখন বিক্রয় কর অনেকে ফাঁকি দেয়। আমরা ফাঁকি দিই না। আমরা মনে করি সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আমরা কর ফাঁকি দেয়ায় বিশ্বাস করি না। এখন সেটা তো হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। কারণ অনেক ক্রেতা মনে করেন কর দুবার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের নীতিমালা হচ্ছে, সরকারের আইনকানুন মেনে ব্যবসা করা। অন্যদিকে পাড়ার একটা দোকানে তো ক্রেতাকে কর দিতে হয় না। ফলে তারা ভাবেন, কেন আমরা কর বা ভ্যাট দেব। সব জায়গায়ই একই কর বা ভ্যাট রাখা উচিত। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেয়া উচিত। তা না হলে আপনি আসলে যে কর দিচ্ছে না, তাকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছেন। অথবা যার ওপর আপনার ওই পরিমাণ গভর্ন্যান্স নেই তাকেই আপনি সুযোগ দিচ্ছেন।

পাড়ার দোকানের ওপরও ভ্যাটের নিয়ম আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এটা দেয় না। এটা আসলে মূলত কর সুশাসনের জায়গা। কর সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা দেখা উচিত। এখন সুপার স্টোরগুলো থেকে প্রাপ্য মোট ভ্যাট বছরে ৮০-১০০ কোটি টাকা। কিন্তু বাজারটা তো অনেক বড়। সব দোকানের ওপর যদি সমানভাবে ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হতো, তাহলে এই ভ্যাট বছরে হাজার কোটি টাকার মতো হবে। এখন সব দোকানের ওপর করটা কীভাবে চালু করা যায়? উৎপাদন পর্যায়ের করের সঙ্গে বিক্রয় কর যোগ করে এমআরপিতে অন্তর্ভুক্ত করলেই হয়। তাহলে ভোক্তারাও দ্বিধার মধ্যে থাকবেন না। যখন উৎপাদন পর্যায়ে করটা আদায় হয়ে যাবে, তখন সব জায়গায় একই কর হবে এবং করও সঠিকভাবে আদায় হবে।

মূল্যস্ফীতি ডলার সংকটের সময়ে এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

আমাদের এই সময়ে সুপারশপের গ্রোথ বেশ ভালো। ডাবল ডিজিট গ্রোথ চলছে। প্রশ্ন আসতে পারে মূল্যস্ফীতির সময়ে আমরা কীভাবে ম্যানেজ করছি। মূল্যস্ফীতির সময়ে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে, আমরা ক্রেতার সঙ্গে থাকব। ক্রেতা যা চিন্তা করে, বাজার অর্থনীতি যেভাবে কাজ করে, সেটার সমন্বয়ে আমরা দাম নির্ধারণ করি। একটা বড় অংশের দাম আমরা নির্ধারণ করি না। এটা উৎপাদকরা ঠিক করেন। আমরা যেসব পণ্য সংগ্রহ করি, যেমন মাছ, মাংস, সেগুলো বাজারের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব সমন্বয় করতে আমরা চেষ্টা করি। সেক্ষেত্রে আমরা ছাড়গুলো দিতে গিয়ে গত বছরের তুলনায় বছর আমাদের গ্রস মার্জিন শতাংশ কমে গেছে। মার্জিন কম হলেও আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেছি।

দ্বিতীয়ত, ডলার সংকটের কারণে আমদানি হচ্ছে না। ফলে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়ে আমরা দু-তিনটা জিনিস করি। একটা হচ্ছে, আমদানিতে ছাড় আছে এমন সব পণ্য অন্য বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে একসঙ্গে নিয়ে আসি। যারা কোনো পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে স্টক আউট হয়ে যাবে বুঝে আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখে, তাদের থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। তৃতীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে, ক্রেতাদের বলা যে বিদেশী এই এই পণ্য আমাদের কাছে নেই। এর বিকল্প দেশীয় এই এই পণ্য আছে। সেগুলোতে ক্রেতাদের আমরা আগ্রহী করে তুলি। দেশীয় পণ্যকে প্রমোট করাটাও আমাদের স্ট্র্যাটেজি। আমার ধারণা, বাংলাদেশের সংকট অনন্তকালের নয়। এটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।

মধ্যবিত্তদের নিয়ে বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

এবারের বাজেট মধ্যবিত্তবান্ধব বাজেট হতে হবে। কারণ সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে মধ্যবিত্তরাই আছেন। তারা সবসময়ই উপেক্ষিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছু বলতেও পারে না। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু তাদের স্যালারি বাড়েনি। বাসা ভাড়া বেড়ে গেছে। সরকার কখনো ব্যবসায়ীদের জন্য বাজেট করেছে, কখনো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের জন্য বাজেট করেছে, কখনো কৃষকের জন্য বাজেট করেছে। মধ্যবিত্তদের বাজেট কই? বিষয়ে সরকারের চিন্তা করা উচিত। শিল্প কৃষির বিকাশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় প্রভাব তৈরি করেছে। এটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। কিন্তু বছর মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। খুচরা ব্যবসায়ের খাতটা অনেক বড়। সরকারের উচিত মডার্ন ট্রেডকে প্রমোট করা। কারণ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় খাত অনেক সহায়ক। খাতে যদি কোনো সিন্ডিকেট থাকে, তাহলে সরকারের পক্ষে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। অর্থনীতিতে মডার্ন ট্রেডের অবস্থান বাড়লে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

তাহলে মডার্ন ট্রেডকে প্রমোট করার পথ কী?

প্রথমত, করের বৈষম্য দূর করা। দ্বিতীয়ত, যেসব পণ্য বা যন্ত্রাংশ আছে, সেগুলো আমদানিতে প্রায় ৫৮ দশমিক শতাংশ করের বিষয় আছে। এটাকে কমাতে হবে। তৃতীয়ত, কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। মডার্ন ট্রেড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা চালু করা যেতে পারে। মডার্ন ট্রেড গ্রো করার জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করা। লো কস্ট ফান্ড সহজ ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এগুলো যদি করা সম্ভব হয়, আমার মনে হয় সেটা সরকারের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। কর আহরণ বলেন আর খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলেন, সেটি মডার্ন ট্রেডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে সহজ। কারণ ১০ লাখ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে চারটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় মডার্ন ট্রেডকে প্রমোট করার সময় এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, সেক্ষেত্রেও মডার্ন ট্রেডের মাধ্যমে তাদের বাজার করা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রা আরো সহজ হয়। সুপারশপ এখন আর বিলাসিতা নয়, প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে মডার্ন ট্রেডের অবদান বাড়াতে হবে। মডার্ন ট্রেডের ভূমিকা শ্রীলংকায় ৪০ শতাংশ, পাশের দেশ ভারতে হার - শতাংশ। আমাদের দেশে বড় জোর শতাংশ বা তার কম হবে। এটি বাড়াতে হবে।

আপনাদের পণ্য সংগ্রহ পদ্ধতিটা কেমন? কৃষকদের সঙ্গে আপনাদের বাণিজ্যটা কীভাবে হয়?

এটা পণ্যভেদে আলাদা হয়। আমাদের ৬০-৭০ শতাংশ পণ্য কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আসে। বাকিটা আমরা পাইকারদের কাছ থেকে নিই। আমরা চেষ্টা করছি সরাসরি কৃষকের সঙ্গে কাজ করতে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে এসিআইয়ের ভূমিকা অনেক বেশি। আসলে একটা প্রযুক্তি বা ফান্ড দিয়ে দিলেই হয় না। এটাকে পরিচালনাও করতে হয়। সুপার মার্কেটকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে চিন্তা করা এবং প্রমোট করতে হবে। তাহলে কৃষক ন্যায্য দাম পাবেন।

সুপারশপের উন্নয়নে সরকারের বিদ্যমান নীতিতে কোনো পরিবর্তন বা পরিমার্জনের প্রয়োজন মনে করেন?

খাদ্যনিরাপত্তার যে নীতিমালা সেটিতে পরিবর্তন না, আমি মনে করি নীতিমালার সমন্বয় করা উচিত। একেকটা গ্রুপ একেকটা নীতিমালা নিয়ে চলে। সেটা একটা নীতিমালা হওয়া উচিত। পুরো বাংলাদেশে একটা নীতিমালা হওয়া উচিত। সবার সেটি মেনে চলতে হবে। এটা এমন না যে, সরকারপ্রধানকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ যা যা মন চাইল, একে ওকে ধরপাকড় করল। আর বলে দিল খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এটা করা খুবই সহজ। কিন্তু যেটা কঠিন সেটা হচ্ছে, সমস্যাটা বোঝা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা। ফলে একটা নীতিমালা দরকার, যাতে আমরা এটার উন্নয়ন করতে পারি প্রতি বছর। বায়োলজিক্যাল ল্যাব দরকার। প্রচুর প্রশিক্ষণও দরকার। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এসে সুপার মার্কেটে তদারকি করে। একেকজনকে সন্তুষ্ট করতে আমাদের একেক নীতিমালা রক্ষা করতে হয়। এখানে আমাদের সমস্যা হয়।

আপনারা পণ্য রফতানি করে থাকেন। খাতে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানির বাজারটা এখন কেমন?

রফতানি আমাদের এখন পর্যন্ত হংকং, সুইডেন আর দুবাইয়ে হয়েছে। প্রায় ৩৭ হাজার ডলারের পণ্য আমরা রফতানি করেছি। ধীরে ধীরে এটি আমরা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন