ভ্যাট আইনে অনলাইন মার্কেটপ্লেস এর সংজ্ঞা সংযোজন অত্যন্ত জরুরি

এ এইচ এম হাসিনুল কুদ্দুস রুশো, চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার, দারাজ বাংলাদেশ

এবারের বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী? ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে কোনো আইন বা নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করেন?

বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের অগ্রগতি খুব বেশি নয়। ইনফ্যান্ট এ খাতের প্রসারে তাই এখনো অনেক নীতিগত সহায়তার প্রয়োজন। বর্তমান ভ্যাট আইনে অনলাইন পণ্য বিক্রয়ের সংজ্ঞায় শুধু রিটেইল ক্রয়-বিক্রয়ের পদ্ধতিকে বোঝায়, এখানে মার্কেটপ্লেসের সংজ্ঞা সংযোজন করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি আইনি ও ভ্যাট প্রেক্ষাপটে সামঞ্জস্য ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে, যা এ খাতের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কেটপ্লেস মূলত একটি প্লাটফর্ম, যা ক্রেতা ও বিক্রেতাকে সংযুক্ত করে। এটি বিক্রেতার হয়ে ক্রেতার অর্ডারকৃত পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয় এবং পণ্যমূল্য সংগ্রহ করে বিক্রেতাকে পরিশোধ করে। সহজভাবে বললে, এটি একটি ডিজিটাল শপিং মল, যেখানে বিক্রেতা একটি ডিজিটাল শপ খুলে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে নানান ধরনের পণ্য প্রদর্শন করতে পারে এবং ক্রেতারা যাচাই করে পছন্দের পণ্যটি কিনতে পারে। এ পদ্ধতিতে পণ্যের মালিকানা কোনো পর্যায়ে মার্কেটপ্লেসের ওপর আসে না, মার্কেটপ্লেস শুধু একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। তাই ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে মার্কেটপ্লেসের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

অন্যদিকে আমরা জানি, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট রয়েছে। সেক্ষেত্রে সব পরিসরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বিদেশী প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেয়ার পরিবর্তে দেশীয় ই-কমার্স প্লাটফর্মগুলোতে বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী করে তুললে এ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব। এ খাতে আয়ের ওপর যদি ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট সুবিধা প্রদান করা হয় তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান আরো অনুপ্রাণিত হবে।

আমদানি ও রফতানিতে ই-কমার্সের ভূমিকা কেমন হতে পারে? এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন রয়েছে কি?

সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব এখন ডিজিটাইজেশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরাও হাঁটছি স্মার্ট বাংলাদেশের পথে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের লাইফস্টাইল এবং কেনাকাটার অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। এ পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি যে পর্যায় দাঁড়িয়েছে, তাতে আমদানি ও রফতানি ব্যবসাকে আরো কার্যকর ও সহজলভ্য করে তুলতে ই-কমার্স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। এতে দেশীয় ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো তাদের পণ্য বিশ্ববাজারে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। এটি শুধু বিশ্বব্যাপী আমাদের পরিচিতিকে তুলে ধরবে না, সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশ থেকে শুধু প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে আমাদের আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে। তাই ই-কমার্সবান্ধব আন্তঃসীমান্ত ব্যবসা নীতি করে দক্ষ ও কার্যকর আমদানি-রফতানি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করতে ই-কমার্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্ভাবনাময় আন্তঃসীমান্ত ব্যবসাকে বাধাহীনভাবে দ্রুত বেড়ে উঠতে বিদ্যমান কাস্টমস (ডি মিনিমিস) বিধিমালা ২০১৯-এ কিছু পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া যেহেতু এটি স্মার্ট আমদানিতে সহায়তা করবে, ফলে একজন ক্রেতা তার প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো পণ্য পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে কিনতে পারবে, এতে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় কমবে। যেমন কারো যদি কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইনের একটি মোবাইল ফোনের কভার প্রয়োজন হয়, তাহলে সে সহজেই কোনো ই-কমার্স প্লাটফর্মের মাধ্যমে তা অর্ডার করে ফেলতে পারবে। এতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রাও দেশের বাইরে যাবে না।

এছাড়া আন্তঃসীমান্ত ব্যবসা সুগম হলে অনেক নতুনত্ব পণ্য দেশে আমদানি হবে, যাতে দেশে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। রফতানির ক্ষেত্রেও চীন-ভারতের মতো বড় ই-কমার্স বাজারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। প্রয়োজনীয় আইনে সংশোধনের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে দেশীয় পণ্য দেশের বাইরে রফতানি করা যায় তাতেও নজর দেয়া সমানভাবে জরুরি।

অন্যদিকে আন্তঃসীমান্ত পেমেন্টের একটি দক্ষ ও সহজ প্রক্রিয়া মাথায় রেখে যথাযথ একটি নীতিমালা তৈরি করলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর ইতিবাচক প্রভাব দ্রুতই চোখে পড়বে।

দারাজ ই-কমার্স ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। এ উদ্যোগ এখন পর্যন্ত কতটুকু সফল বলে আপনি মনে করেন? এখানে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে?

বিশ্ব প্রতিদিন ডিজিটাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ গতিতে এগোতে থাকলে এমন দিন খুব দূরে নয় যখন ই-কমার্সে কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা থাকবে না। মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো দেশ থেকে কেনাকাটা করতে পারবে। পুরো বিশ্ব হয়ে যাবে একটি বিশাল ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস। তাই সময় এসেছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ই-কমার্সবান্ধব নীতিমালা তৈরি করার, যা আমাদের গ্লোবাল কম্পিটিশনে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে। এ খাতের প্রসারে এসব নীতি ই-কমার্স ইকোসিস্টেমের বিকাশকে মাথায় রেখে করতে হবে, যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সুদূরপ্রসারী বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করবে। তাই সরকার ও প্রাইভেট সেক্টরগুলোর সম্মিলিতভাবে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে, যাতে একটি ই-কমার্সবান্ধব নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।

দেশের ই-কমার্স ব্যবসায় ক্যাশ অন ডেলিভারির প্রতি ক্রেতাদের ঝোঁক দেখা যায়, এটা কি তাদের ই-কমার্স খাতের প্রতি আস্থার সংকটের কারণ বলে আপনি মনে করেন?

ক্যাশ অন ডেলিভারির প্রতি ক্রেতাদের ঝোঁকের পেছনে আসলে অনেক কারণ রয়েছে, যেমন এখনো অনেকে ডিজিটাল পেমেন্টে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না বা অনেকের কাছে ডিজিটাল পেমেন্টের অ্যাকসেস নেই। তাছাড়া আস্থার সংকট তো রয়েছেই। আগে কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠানের জন্য ই-কমার্স খাতের প্রতি আস্থার সংকট সৃষ্টি হলেও ক্রেতারা ধীরে ধীরে এ সংকট কাটিয়ে উঠছে। এখন ক্রেতারা জানে কোন পণ্য অনলাইনে কিনতে হলে আগে সেলার রিভিউ, প্রডাক্ট রিভিউ ও প্লাটফর্মের অথেন্টিসিটি যাচাই করে কিনতে হয়। এছাড়া আগে ই-কমার্সের জন্য কোনো সরকারি নির্দেশনা ছিল না, কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট গাইডলাইন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সহজ রিটার্ন ও রিফান্ড পলিসি এ আস্থার সংকট অনেকটা দূর করেছে।

বাংলাদেশে দারাজের বর্তমান ব্যবসায় পরিস্থিতি কেমন, আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

এখন আমাদের প্ল্যাটফর্মে পণ্যের ১৬ মিলিয়নের বেশি অ্যাসোর্টমেন্ট আছে, যা ৬৪টি জেলায় সময় মত ডেলিভারি করতে প্রায় ৩ হাজার ডেলিভারি বাহন নিয়োজিত থাকে। 

এছাড়াও আমরা ক্রেতাদের কেনাকাটার সুবিধাকে মাথায় রেখে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। যেমন বেস্ট প্রাইস গ্যারান্টি, অথেন্টিক প্রোডাক্ট চ্যালেঞ্জ , দারাজের চেরাগের মত উদ্যোগ ক্রেতাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী কেনাকাটা করতে সহযোগিতা করবে। 

ক্রেতারা যেন নিশ্চিন্তে কেনাকাটা করতে পারেন সেজন্য আমরা কিস্তিতে পেমেন্ট করার সুবিধাসহ সবধরণের পেমেন্ট, ও সহজ রিটার্ন-রিফান্ড অপশন রেখেছি। এছাড়াও, রেটিং, রিভিউ এবং রিটার্ন রেট এর উপর ভিত্তি করে আমরা নিয়মিত প্ল্যাটফর্মের বিক্রেতাদের মূল্যায়ন করি ও যথাযথ ব্যবস্থানেই এবংদারাজ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে তাদের কোয়ালিটিসেল সম্পর্কে সচেতন করি। 

বুঝতেই পারছেন দারাজে গ্রাহকদের ভ্যালু ফর মানির নিশ্চয়তা দিয়ে একটি সেরা কেনাকাটার অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার জন্যই আমাদের কঠোর পরিশ্রম করা। আশা করছি সবাই একসাথে কাজ করলে আমরা সহজেই এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন