আমিনুল ইসলামের ‘অর্গানিসিটি’

সিলভিয়া নাজনীন

বেঙ্গল শিল্পালয়ে আমিনুল ইসলামের শিল্পকর্ম নিয়ে চলমান প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন ওয়াকিলুর রহমান ছবি: বেঙ্গল শিল্পালয়

আমিনুল ইসলাম পঞ্চাশের দশকের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। পঞ্চাশের দশকে অধিকাংশ শিল্পী একাডেমিক লেখাপড়া শেষ করে, শিল্পের নানা ধারা যেমন কিউবিজম, অভিব্যক্তিবাদ বা বিমূর্ততাবাদ ইত্যাদি শিল্প আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করে নিজস্ব চিন্তায় স্থিত হয়েছিলেন। এ সময়ে আমিনুল ইসলাম বিমূর্ততাকে বেছে নিয়েছেন। তিনি ঢাকার শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করে ইতালির ফ্লোরেন্সে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এ সময়ের গুরুত্ব আমিনুলের কাছে সর্বাধিক। পূর্ববর্তী সময়ে তিনি বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তার শুরুর দিকের চিত্রকর্মে আমরা সামাজিক সচেতনতার সেই দায়বোধ দেখতে পাই। 

পশ্চিমের শিক্ষার ধারায় তিনি চিত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান আর অনুষঙ্গকে ব্যবহার করার প্রকৃষ্ট সংযোগ খুঁজে বেড়িয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে আমি মূলত একজন অ-আলংকারিক চিত্রশিল্পী হিসেবে বেড়ে উঠেছি এবং বিভিন্ন মাধ্যম এবং শিল্পের ফর্মগুলোয় পরীক্ষা করার জন্য আমার প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু করেছি। ক্রমান্বয়ে আমি কলম, পেন্সিল, ব্রাশ, ব্রাশ-এন্ড, বাতিল ব্রাশ, ম্যাচ বাক্সের সমতল প্রান্ত বা কালি পট কিংবা ড্রপার থেকে কালি ঢেলে তৈরি রেখার বিভিন্ন গুণাবলি সম্পর্কে আরো বেশি সচেতন হয়েছি। একটি সিরিঞ্জ থেকে রঙ প্রয়োগ করেছি। আমার চিত্রকর্মকে একটি স্বতন্ত্র চেহারা দেয়ার জন্য এ উপাদানগুলো রেখার অনেক চরিত্র তৈরি করেছিল।’

ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে আমিনুল ইসলামের প্রদর্শনী ‘অর্গানিসিটি’। এতে শিল্প সংগ্রাহক আবুল খায়েরের সংগ্রহে থাকা আমিনুল ইসলামের ১৯৭০ থেকে ২০০০ সময়ের ড্রইং প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। 

তার কাজে স্বতঃস্ফূর্ততা বিদ্যমান। অটোমেটিজম বা যা কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রিত জীবন তার বাইরে গিয়ে তিনি সবকিছু করতে চাইতেন। ১৯৫৬ সাল থেকে নির্বস্তুকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন আমিনুল ইসলাম। তিনি এগিয়েছেন রঙ, রেখা, বস্তুর আকৃতির বিন্যাসের দিকে, দোদুল্যমান রেখা, বক্র রেখা, সমান্তরাল রেখা ইত্যাদির নান্দনিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রাণকেন্দ্র ফ্লোরেন্সে এবং কাকতালীয়ভাবে পৃথিবীর সাহিত্যজগতের অন্যতম মহাকবি দান্তের বাড়ির অনতিদূরে আমি, হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ—এ তিন বাঙালি তরুণ শিল্পীর প্রথম আস্তানা নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনে এক তাৎপর্য সৃষ্টি করেছিল। শিল্পকলা নিয়ে আমাদের স্বকীয় চিন্তাচেতনা, স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক ভাবনা সম্বন্ধে সূক্ষ্ম ও বৈচিত্র্যময় জিজ্ঞাসায় জটিলতম তত্ত্বগুলোর আলোচনারও সূত্রপাত এ স্বল্পকালীন একত্রবাস থেকেই সূচিত হয়েছিল, যা পরবর্তী প্রায় তিন বছরের ইউরোপীয় অভিজ্ঞতায় আরো সমৃদ্ধ হয়েছে।’ 

আমিনুল ইসলাম রেখার ত্রিমাত্রিক প্রাণবন্ত ধারণা এবং নির্জীব বা কল্পিত বস্তু আঁকতে এবং চিত্রিত করতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম দ্বারা নান্দনিক বিন্যাস ঘটিয়েছেন। ভাষা যেমন শব্দ প্রদান করতে পারে, তেমনি সূক্ষ্ম, প্রশস্ত, সোজা, বাঁকা, গাঢ়, ছন্দময়, দ্রুত, নিয়মিত, অনিয়মিত, ভাঙা, স্বতঃস্ফূর্ত, কৌণিক, প্রতিসম রেখা শিল্পকর্ম নির্মাণকে বিস্তৃত করতে পারে। শিল্পী আমিনুল তার চিত্রিত বিষয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের রেখা ব্যবহারের মাধ্যমে কেবল বাহ্যিক চেহারাই নয়, আবেগের দিকটিও চিত্রিত করেছেন। কম্পোজিশনের মধ্যে ভারসাম্য, সামঞ্জস্য ও সামগ্রিক ছন্দের মতো আরো অনুষঙ্গ রয়েছে, সেই সঙ্গে দক্ষতা এবং দক্ষতা দিয়ে শিল্পী তার নিজস্ব মানসিক অবস্থা, অভিব্যক্তি বা তীব্র অনুভূতিকে উপস্থাপন করেন তার চিত্রপটে। এখানে শিল্পীর আত্মিক ভাবনা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি তার নানা অভিজ্ঞতার বিস্তার ঘটেছে। 

শিল্পী আমিনুলের আধা জ্যামিতিক রেখা, মূর্ত-বিমূর্তের দোলাচল আবার সম্পূর্ণ নির্বস্তুকতায় রূপান্তর হওয়ার প্রক্রিয়া এসবই দেখা যায় এ প্রদর্শনীতে। কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘সাদা জমিনে কালো রেখার টান কাগজে ফুটিয়ে তোলে জ্যামিতিক মাত্রা। উল্লম্ব রেখাগুলোকে লতার মতো জড়িয়ে থাকা অন্যান্য রেখার বিন্যাস এক ধরনের ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত করে। দেখে মনে হতে পারে, এসব রেখা আটকে আছে তাদের আলোহীন উদ্দীপনার মধ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা ভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে সংযুক্ততা অথবা একই উদ্দীপনার প্রতিনিধিত্বকারী।’

আমিনুল ইসলামের এ পর্যায়ের চিত্রকর্মগুলো দেখে ধারণা পাওয়া যায়, এগুলো তার অভিজ্ঞতার একটি অংশের প্রকাশ মাত্র। তার শিল্পজীবন, দৃশ্যমান জগতের প্রতি তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার ছবি আঁকার উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি উপস্থাপন করেছেন। দিকনির্দেশ করে এবং সামগ্রিক ছন্দ, ভারসাম্য, সামঞ্জস্য তৈরি করে এমন কিছু রেখার ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। তার চিত্রতলে অসংখ্য বিশৃঙ্খল রেখাগুলো আঁকার কাজ সমাপ্ত করার দিকে একটি ভূমিকা পালন করেছে। এসব উপাদান এবং তাদের কম্পনগুলো একটি জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া তৈরি করে হয়তো শিল্পীর মনে, যা তার কাজের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে অঙ্কনের নির্দিষ্ট উপাদানগুলোয় জোর দিতে বাধ্য করে। যদিও অঙ্কনের একটি সামগ্রিক ঐক্য এবং জীবনশক্তির দিকে ইঙ্গিত করে এমন একটি সত্য অবস্থানও সেখানে দেখতে পাওয়া যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন