আমিনুল ইসলাম

পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন খুব

রফিকুন নবী

ছবি: বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

১৯৫৯ সালে আর্ট কলেজে ভর্তির পর যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম আমিনুল ইসলাম ছিলেন তাদের মধ্যে তরুণতমদের একজন। দারুণ স্মার্ট। সদ্য কিছুকাল আগে ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত একাডেমি থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশে ফিরেছেন। তখনই নামি-দামি শিল্পী। পাকিস্তানজুড়ে খ্যাতি। এক ডাকে সবাই চেনে। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারেও ভিন্নতর। অনেকটাই চলতি নিয়ম-কানুনকে না মানা, তোয়াক্কা না করা স্বভাবের।

তার সম্বন্ধে আলাপ করতে গিয়ে আজও শিল্পকলা অঙ্গনের সব দিক বিচারে কেউ যদি সবচেয়ে আধুনিক শিল্পী হিসেবে কাকে সর্বাগ্রের স্থানটি দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবনায় থাকেন তো আমি বলব তিনি আমিনুল ইসলাম। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ‘সবচেয়ে সাহসী শিল্পী কে?’, সেক্ষেত্রেও উত্তর হবে শিল্পী আমিনুল ইসলাম।

আসলে সব দিক দিয়েই আষ্টেপৃষ্ঠে একজন যুগোপযোগী আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি। ছবি আঁকা থেকে শুরু করে জীবনাচারের সর্বক্ষেত্রে আধুনিকতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে, তাঁর সমকালীন চলতি পরিবেশকে ডিঙিয়ে অগ্রসরমান ছিলেন, ছাত্রদের সঙ্গে মিশতে পারতেন অবলীলায়। বন্ধুদের আড্ডায় জমে যেতে পারতেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় দিক ছিল যে তিনি বিশ্বের শিল্পীদের অত্যাধুনিক চর্চাগুলোকে প্রত্যক্ষ করে নিজে তেমন হওয়ার যেমন চেষ্টা করতেন, তেমনি কনিষ্ঠ শিল্পীদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন।

আর্ট কলেজে ছাত্র হওয়ার পর তাকে কেমন দেখেছি তার একটি চিত্র তুলে ধরছি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চুল ব্যাকব্রাশ, পরনে খাটো আর সরুপা প্যান্ট তখনকার পশ্চিমি হালফ্যাশনের, গায়ে রঙিন শার্টের ওপর ইউরোপের শিল্পীদের বিশেষ পরিধেয় এক ধরনের জ্যাকেট। কখনো কখনো আবার ওই পোশাকের সঙ্গে টাইও পরতেন। পায়ে ক্রেপসোল জুতা। সব মিলিয়ে ইউরোপীয় শিল্পীদের ধাঁচ। ঈষৎ দ্রুত কথা বলার ধরন। ঠোঁটে সবসময় সিগারেট। মেলামেশায় সহজিয়া ভাব।

ছাত্রদের সঙ্গে সহজভাবে মিশলেও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বটুকু বজায় রাখতে পারতেন চমৎকার পারদর্শিতায়। সব মিলিয়ে হ্যান্ডসাম একজন শিল্পী। শিল্পকলার নতুন ছাত্র হিসেবে তখন চোখ-কান খুলে সবকিছু দেখার চেষ্টা করি। কলেজের সবকিছুকেই ‘অবাক করা’র মতো মনে হতো। শিল্পীরা কে কেমন, শিক্ষক হিসেবে সবার সঙ্গে সবার পার্থক্যগুলো কী, কে কেমন পড়ান—এসব গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করতাম। একধরনের অনুসন্ধিৎসা মতোই ছিল সেই দেখা। আবিষ্কার করেছিলাম সবার আধুনিকমনষ্কতাকে। কিন্তু তার মধ্যেও শিল্পী আমিনুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি ছিলেন আরো বেশি আধুনিক। এবং নিজে যে আধুনিক তা-ই নন, চাইতেন যে ছাত্ররাও যেন সেদিকে ঝোঁকে। তাঁর সাজ-পোশাক এবং চালচলন দেখে মধ্য ষাটের দশকে আমরা তাঁকে প্রখ্যাত হলিউড অভিনেতা ‘জেমস-ডিন’ আখ্যা দিয়েছিলাম আড়ালে। তখন অবশ্য আমিও শিক্ষক হয়ে গিয়ে তার সহকর্মী বনে গেছি।  ছাত্রত্বের চেয়ে সহকর্মী হিসেবেই পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল কলেজে কাটিয়েছি। সেইসঙ্গে শিল্পী হিসেবে তো সারা জীবন একই অঙ্গনের বাসিন্দা থাকতেই হয়েছে। এ কথাগুলো উল্লেখ করছি এজন্য যে আমি তাকে তিনভাবে দেখেছি, মিশেছি। প্রথমত, শিক্ষক হিসেবে, দ্বিতীয় অধ্যায় সহকর্মীর এবং তৃতীয়টি শিল্পী হিসেবে।

আমার ছাত্রজীবনে তাকে দেখেছি তার মতো করে আধুনিক ভাবাদর্শে দীক্ষিত করার চেষ্টায় নিবেদিত। সহকর্মী হিসেবে দেখেছি চারুকলা শিক্ষাকে কী করে আন্তর্জাতিক মানের করা যায় তা নিয়ে ভাবতে। আর সবশেষে শিল্পকলা জগতের একজন হয়ে দেখেছি তাবৎ শিল্পকলাচর্চার দিকগুলোকে পরিবর্তন করতে প্রত্যয়ী একজন শিল্পী হিসেবে। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারটিতে সাংগঠনিকভাবেই কিছু করারও চিন্তা করতেন।

এসবের চেষ্টা চালাতে তিনি শিল্পীদের সংগঠন চারুশিল্পী সংসদকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বহুবার। এবং তার ভাবনায় সবসময়ই বিদ্যমান ছিল দেশের শিল্পকলাকে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনের বিশ্বের সঙ্গে নামি-দামি করে সংযুক্ত করা। এক্ষেত্রে তিনি চারুশিল্পী সংসদের সবাইকে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিতেন। বলতেন, ‘‌বিশ্বের শিল্পীদের স্বার্থ এবং নির্বিঘ্ন কলাচর্চায় যে আন্তর্জাতিক শিল্পী-সমিতি রয়েছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিল্পকলার ক্ষেত্রে তো আমাদের এখন একটা ভালো অবস্থান। এখন সময় এসেছে ইনডিভিজ্যুয়ালি দু-একজনের সম্পৃক্ত হওয়ার চেয়ে পুরো শিল্পীসমাজেরই তা হওয়া উচিত।’

এসব বলতেন এবং কিছুই না করতে পারার জন্যে প্রায়ই তা নিয়ে আক্ষেপ করতেন। ভর্ৎসনা করতেও ছাড়তেন না আমাদের। যতদূর জানি, আমাদের ওপর ভরসা করতে না পেরে শেষে নিজেই জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের কয়েকজনকে সঙ্গী করে সে চেষ্টাটি করেছিলেন এবং খানিকটা এগিয়েও ছিলেন। 

আপাতদৃষ্টিতে আমি দেখেছি যে কখনো তার মধ্যে ইমোশনাল ভাবটি চাপা থাকত, অপ্রকাশিত থাকত। ব্যাপারটি অন্তর্মুখিনতায় ঢাকা থাকত বলা যায়। অথচ আমি তাকে সংবেদনশীল হতে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ, জামাকাপড় ও অর্থ জোগাড়ে আমাদের নেতৃত্ব দিতেন। আমরাও এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে সেভাবে পেয়ে নির্ভয়ে এ রিস্কি কাজটি করতাম। অনেক ক্ষেত্রে আর্ট কলেজেই জড়ো করে রাখা হতো সেসব তার দায়িত্বে। তিনি তা সুযোগমতো পৌঁছে দিতেন সংশ্লিষ্টদের হাতে।

সাহসী ছিলেন খুব। আর তা ছিলেন বলেই ১৯৪৭-এর পর আমাদের এ ভূখণ্ডের শিল্পকলা বিষয়ে ‘‌নাই-কিছু’ অবস্থাকে তুচ্ছজ্ঞান করে ভূত-ভবিষ্যৎকে তোয়াক্কা না করে ১৯৪৮-এ নবস্থাপিত আর্ট কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন প্রথম ছাত্র হয়ে। যুক্ত হয়েছিলেন শিল্পকলার চর্চা এবং প্রসারের আন্দোলনে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ শিক্ষক-শিল্পীর সঙ্গে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। মিটিং-মিছিলের জন্যে ফেস্টুন এঁকেছেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনেও তাই। তার সেসময়ের একটি ছবির সিরিজ এখনো অবাক করা বলে আমার মনে হয়। সিরিজটির মূল বিষয় ছিল ‘‌শিকল’। ঘাতক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাকে বিষয় করে স্বাধীনতা-উত্তরকালে তো তিনিই সবচেয়ে বেশি ছবি এঁকেছেন। এসব নিয়ে প্রদর্শনীও করেছেন।

যা-ই হোক, প্রথম বর্ষেই মাঝামাঝির দিকে তাকে শিক্ষক হিসেবে পাই। তিনি পড়াতেন নন্দনতত্ত্বের নানা দিক। তাতে প্রাধান্য দিতেন ‘এলিমেন্টস অব ডিজাইন’ বিষয়টিকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিত্রকলাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতেন। ইজমগুলোও তা থেকে বাদ যেত না। তবে চিরাচরিত কনভেনশনাল একাডেমিক পদ্ধতিকে খুব একটা সমর্থন করতেন না। তত্ত্বগত দিক পড়ানো শেষে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতেন নানা রঙের কাগজ সেঁটে অথবা ছিঁড়ে নকশা তৈরির। এতে কী করে আধুনিকতা এসে যায় তা দেখাতেন। সহজ করে দিতেন কঠিন বিষয়াদিকে। কাগজের আকারগুলো একের সঙ্গে আরেকটি মিশে কেমন ভিন্ন ফর্ম তৈরি করে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তা শেখাতেন। ব্যাপারটি আমাদের জন্য ছিল একেবারেই নতুন। নানাভাবে ছবি এঁকেছেন সারাজীবন। পরিবর্তনও করেছেন মাঝেমধ্যেই। এক ধরন থেকে আরেক ধরনে নিজেকে সরিয়েছেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই বিমূর্তেই রেখেছেন নিজেকে। ষাটের দশকে শুধু রঙবিন্যাসী ছবিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আবার বদলে গিয়ে রঙের সঙ্গে ভাঙা ফর্মকে যুক্ত করে ক্যানভাস সাজিয়েছেন। কখনো কখনো প্রয়োজনে বাস্তবধর্মী আবার কখনোবা পরাবাস্তব ধরনকে গ্রহণ করেছেন। আবার কিছুকাল ‘‌কোলাজ’-কে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন। এ পর্যায়ে ক্যানভাসে আয়না কোলাজ করে অর্থবহতা আনার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে বড় সাফল্য তার ‘‌ম্যুরাল’ চিত্রে, বিশেষ করে মোজাইকে। এ ব্যাপারে তিনি যে দেশের সেরা শিল্পী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষ কথা এই যে এত আধুনিকতা-অতি আধুনিকতাচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেও ‘ড্রইং’-কে সবার ওপরে মূল্য দিতেন। এ ব্যাপারে নিজে যেমন দক্ষ ছিলেন, তেমনি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদেরও উৎসাহিত করতেন। শুধু তাই না, এ ব্যাপারে চারুকলার সেরা ছাত্রদের তিনি বৃত্তিও দিতেন প্রতি বছর।

লেখাটি (সংক্ষেপিত) বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত ‘‌অনন্য আমিনুল ইসলাম’ গ্রন্থ থেকে নেয়া

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন