করিডোর

হলুদরঙ মানে সরষেখেত হলুদবিন্দু মানে জোনাকি

ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলমান প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৯ মে

অসংখ্য হলুদডট, প্রজাপতি, মেহেদি পাতা, দোপাটি, রঙধনু-ঘুড়ি আর ঝিঙেফুল মিলেমিশে আছে উজ্জ্বল রঙের সব ক্যানভাসে। রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলমান শিল্পী লায়লা শার্মিনের চিত্রকর্মের প্রদর্শনীতে খুঁজে পাওয়া যায় ঐতিহ্য-অনুষঙ্গের অপ্রচলিত কম্পোজিশন। মিশ্র মিডিয়া ব্যবহার করে কাগজ ও ক্যানভাসে ‘গোল্ডেন বেঙ্গল’ সিরিজের মাধ্যমে জন্মভূমির সঙ্গে শিল্পী তার মানসিক ও আত্মিকযোগ তুলে ধরেছেন—

শৈশব-শিল্প: আমার কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়েছিল, বড় হয়ে কী হতে চাও? মনে আছে, বলেছিলাম—শিল্পী হব। আমার বাবা (আবুল হোসেন খান) ভালো ছবি আঁকতেন। গান গাইতেন। আমাদের পারিবারিক আবহ ছিল সংগীত ও শিল্পমিশ্রিত সুস্থ সংস্কৃতির আবাসস্থল। ভাই-বোনেরাও গান শিখতেন। ওস্তাদ আবদুল আজিজ আসতেন বাড়িতে। মাকে দেখতাম দুপুরে শুয়ে বই পড়তে। আমি লুকিয়ে প্রথম মায়ের বালিশের নিচ থেকে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ বইটা নিয়ে পড়ি। দেশের জন্য পাভেল ও তার মা পেলেগোয়ার বিপ্লব—নিজেদের উৎসর্গ করা—এ ধারণা ও বোধ আমাকে তাড়িত করে। পরবর্তী সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বিএফএ-এমএফএ সম্পন্ন করি।

চলমান প্রদর্শনী ‘গোল্ডেন বেঙ্গল’: টিএস এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশ, কান্ট, দেরিদা, ফুকোর সাহিত্য ও দর্শন এবং বাংলার বিভিন্ন মিথ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রদর্শনীর চিত্রকর্মে বিভিন্ন ধরনের অনুষঙ্গ আছে—পদ্ম ফুল, ঘুড়ি, জোনাকি, নদীতে সাঁতাররত শিশু, হাঁস, ধানখেত, কচুরিপানা—যা মানবতা, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক। আমার কাজে হলুদ রঙ মানে সরষেখেত। হলুদ বিন্দু মানে জোনাকি বুঝিয়েছি। নীল-লাল-কমলা মানে রঙধনু। ব্যবহার করেছি আনইউজুয়াল কম্পোজিশন। আমি ১৮ বছর ধরে ম্যাটেরিয়ালিস্ট গ্রিডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। যখন আমার চিত্রগুলো নিয়ে কেউ গভীরভাবে ভাববে, তখন উপলব্ধি করতে পারবে। প্রযুক্তির এ সময়ে আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে যূথবদ্ধ হওয়ার সময় নেই। রঙধনু, কাশফুল, শেফালি ফুল, বেলির সহজাত যে সৌন্দর্য তা দেখার সময় নেই। এ প্রদর্শনীতে ৩০টি চিত্রকর্মের পাশাপাশি রয়েছে আমার নতুন ইনস্টলেশন, ‘রিটার্ন টু নেচার’। আমি আমার কাজের মাধ্যমে গ্লোবাল ওয়ার্মিং সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি ও প্রকৃতির কাছে ফিরে আসার আহ্বান জানাই। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের ধরিত্রী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। আমাদের নদী-পাহাড় আমাদের আত্মীয়। অথচ আমরা ওদের নষ্ট করছি।

স্বচ্ছন্দের মাধ্যম: অ্যাক্রিলিকে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তবে আমি প্রিন্টমেকিংয়ে পড়েছি, এচিংয়ে মাস্টার্স করেছি। যদিও এ কাজগুলো করতে বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম লাগে। ভালো প্রিন্ট মেকিংয়ের স্টুডিও ছাড়া কাজগুলো করাটা কঠিন।

প্রিয় শিল্পী ও কাজ: মোহাম্মদ কিবরিয়া আমার শিক্ষক ছিলেন। স্যারের কাজ আমার অসম্ভব পছন্দের। এছাড়া মনিরুল ইসলাম, সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ ভালো লাগে। বাইরের দেশের শিল্পীদের মধ্যে আমেরিকান শিল্পী সাই টুম্বলির কাজের কথা বলব। তার কম্পোজিশন, রঙের পরিমিতি বোধ ও মুন্সিয়ানায় আমি মুগ্ধ। এছাড়া ভাস্কর আলেকজান্ডার কেলডারের ভাস্কর্য ভালো লাগে। মাস্টার আর্টিস্টের মধ্যে হেনরি মাতিস, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, সালভাদর দালির কথা বলতেই হয়। মনে আছে ফ্লোরিডায় আমি দালির এচিং প্রিন্ট দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল, এত সুন্দর প্রিন্ট কীভাবে কেউ করতে পারে।

প্রদর্শনী-পুরস্কার: ভবিষ্যতে গোল্ডেন বেঙ্গল কাজটি কানাডায় প্রদর্শনীর চিন্তা রয়েছে। এর মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে আমি বিশ্বকে সচেতন করতে চাই। এ পর্যন্ত ৬০টি আন্তর্জাতিক দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। গোল্ডেন বেঙ্গল আমার ১২তম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। ২০১১ সালে কোরিয়ার সিউলের ওসিআই মিউজিয়াম অব আর্টে অনুষ্ঠিত মর্যাদাপূর্ণ ১৬তম স্পেস ইন্টারন্যাশনাল প্রিন্ট দ্বিবার্ষিকীতে পুরস্কৃত হই। ২০১৭ ও ২০২২ সালে ভেনিস বিয়েনেলে প্রকল্পে আমার কাজ প্রদর্শিত হয়।

গ্রন্থনা: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন