জরুরি স্বাস্থ্যসেবা

সীমিত সুযোগের সমাজে অত্যাবশ্যক

বিশ্বে ক্রমাগত নানা রকম উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। এর সঙ্গে দ্রুত ঘটেছে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, পাশাপাশি বাড়ছে জীবনকালও। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবায় জরুরি চিকিৎসার চাহিদা বাড়ছে। জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিস্থিতির মতো জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা, দীর্ঘস্থায়ী কিছু রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য অবস্থার অবনতির ক্ষেত্রে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জরুরি চিকিৎসা পরিস্থিতি এবং সেবার মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় অপ্রত্যাশিত চিকিৎসা হওয়ার কারণে জরুরি পরিস্থিতি বা আঘাত পেলে কিংবা অসুস্থতায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নিতে হয়, যা বিলম্বিত হলে বা দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে মৃত্যু বা অক্ষমতার শিকার হতে পারে ব্যক্তি। এ ধরনের কিছু কমিউনিটি জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা (কমিউনিটি ইমার্জেন্সি) হলো: পানিতে ডোবা, আঘাত, গরুর গুঁতো, হাড়ভাঙা, সাপে কাটা, বিষক্রিয়া, কেটে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, বজ্রপাত, গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, পাহাড় ধস/মাটিচাপা, আত্মহত্যার চেষ্টা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়া, গলায় কিছু আটকে যাওয়া, কুকুরের কামড় ইত্যাদি। এছাড়া অন্যান্য জরুরি অবস্থার মধ্যে  রয়েছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হঠাৎ অজ্ঞান, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, তীব্র পেট ব্যথা, রক্তচাপ কমে যাওয়া (শক অবস্থা) ইত্যাদি। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প-পরবর্তী জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা তো আছেই। 

এ ধরনের রোগীর চিকিৎসায় রোগীকে জরুরিভাবে হাসপাতালে নেয়া উচিত। উন্নত দেশে অবশ্যই এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা ক্রিটিক্যাল কেয়ার/নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) করা হয়। এসব রোগীর জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিক, হাসপাতালে রোগী পরিবহনের সময়, হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে যেমন—জরুরি বিভাগ থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে পরিবহনের সময় একিউট কেয়ারের প্রয়োজন পড়ে। এ সময় রোগীর বন্ধ হওয়া হৃদযন্ত্রের উজ্জীবন (সিপিআর), হৃদযন্ত্র বন্ধ হলে কী করণীয়, কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা, শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলে শ্বাসনালি উন্মুক্ত করার পদ্ধতি, সংজ্ঞাহীন ব্যক্তি বমি করতে থাকলে কী করণীয়, সংজ্ঞাহীন ব্যক্তিকে আরোগ্য অবস্থায় রাখার পদ্ধতি জানা প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন। জনসাধারণের মধ্যে এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী সিপিআর কাউন্সিল আছে যারা শতকরা ১০ ভাগ বয়স্ক মানুষকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। জরুরি অবস্থায় হাসপাতালে রোগী পরিবহনের সময় অ্যাম্বুলেন্সে এ ধরনের ব্যবস্থায় হৃৎপিণ্ডে ডিসি শক দেয়ার ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী থাকেন। এ ধরনের ব্যবস্থা বাংলাদেশেও থাকা প্রয়োজন।

ক্রিটিক্যাল কেয়ার একটি তুলনামূলক নতুন ধারা। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় আইসিইউ শয্যা এবং দক্ষ মানবসম্পদের সংখ্যা সীমিত। যদিও এ ধরনের সেবার প্রয়োজনে রোগীর সংখ্যার অনুপাতে তা কিছুটা বাড়ছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ অতিমারীর সময় থেকে। অদূর ভবিষ্যতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে তেমনটা প্রত্যাশা করা হচ্ছে না। আইসিইউ শয্যার অভাবে রোগী হয়তো অনেক খরচে প্রাইভেট আইসিইউতে চিকিৎসা নেন কিংবা বাড়ি নিয়ে যান বা হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। প্রধান প্রধান মেডিকেল কলেজ/জেলা হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগীর জরুরি সেবার প্রয়োজন পড়ে। একাধিক জায়গায়/ওয়ার্ডে তাৎক্ষণিক এ ধরনের জরুরি সেবার ব্যবস্থা না করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ২৪/৭ চালু সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপাদান সরবরাহ করে অনুশীলন করা হলে চিকিৎসা কিছুটা কার্যকর হবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি ‘মানবীয় কারণগুলো’ বিবেচনায় রাখতে হবে। অপরিহার্য জরুরি এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার প্রদানের সময় রোগীর নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য মাইক্রো-ম্যাক্রো এবং মধ্যবর্তী স্তর বিবেচনা করে একটি ‘পদ্ধতির পথ’ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বর্তমান বাংলাদেশ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রাম, হাসপাতালের বিভিন্ন প্রধান ক্লিনিক্যাল বিভাগে ১০ শতাংশ শয্যার ব্যবস্থা রেখেছে যাতে ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি তৈরি করে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ আছে। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি ক্লিনিক্যাল ব্যবস্থাপনা প্রটোকল’-এর প্রশংসনীয় নথি স্বাস্থ্যসেবাজুড়ে সামঞ্জস্য তৈরি করার একটি উদাহরণ। আমরা প্রধান ক্লিনিক্যাল বিভাগগুলোয় স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতিভিত্তিক অপরিহার্য জরুরি এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার প্রদানের জন্য ঐকমত্যে আসতে পারি। যেখানে যাদের নিবিড় যত্নের প্রয়োজন কিন্তু আইসিইউ শয্যা পাওয়া যায় না বা যারা অর্থের সংকুলান করতে পারে না, তেমন সব গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য ন্যূনতম অবস্থান ও নানা উপকরণসহ নির্ধারিত স্থান নির্ধারণ করে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের নির্দিষ্ট স্থানে পরিচালিত একিউট মেডিকেল ব্যবস্থাপনায় মৃত্যু এবং অক্ষমতার ঝুঁকি হ্রাসে এর প্রভাব দেখার জন্য গবেষণা করা যেতে পারে।

জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যায় রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নেয়া কিংবা কার্যকর রেফার করার পদ্ধতির জন্য একটি চিকিৎসা নেট তৈরি প্রয়োজন। জরুরি কমিউনিটি স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো প্রতিরোধে, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান ও মোটরযানে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাতে অনেক পরিস্থিতি সহজ হয়ে যাবে। 

ডা. এমএ ফয়েজ

অধ্যাপক, মেডিসিন ও সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন